জয়িতা অন্বেষনে গাবতলীর চার সংগ্রামী বাংলার নারী
আল আমিন মন্ডল (বগুড়া) থেকেঃ জয়িতা অন্বেষনে বাংলাদেশ শীর্ষক প্রতিযোগিতায় বগুড়ার গাবতলী উপজেলা পর্যায়ে চার ক্যাটাগরীতে চার সংগ্রামী সফল বাংলার নারী নির্বাচিত হয়েছে। মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের গাবতলী উপজেলা মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরের উদ্যাগে যাচাই-বাচাই করা হয়। গাবতলী উপজেলা প্রশাসনের সহযোগিতায় ‘অর্থনৈতিক ভাবে সাফল্য অর্জনকারী নারী’ ক্যাটাগরীতে শ্রেষ্ট জয়িতা হয়েছেন মোছাঃ নুরজাহান বেগম। ‘সফল জননী নারী’ ক্যাটাগরীতে শ্রেষ্ট জয়িতা মোছাঃ আশরাফুন নেছা।‘নির্যাতনের বিভিষিকা মুছে ফেলে নতুন উদ্যেমে জীবন শুরু করেছে যে নারী’ ক্যাটাগরীতে শ্রেষ্ট জয়িতা মোছাঃ শাহানুর আকতার ও ‘সমাজ উন্নয়নে অসামান্য অবদান রেখেছে যে নারী’ ক্যাটাগরীতে শ্রেষ্ট জয়িতা মোছাঃ শামিমা আকতার নারগিছ নির্বাচিত হয়েছে। বাংলার নারী ‘অর্থনৈতিক ভাবে সাফল্য অর্জনকারী নারী’ জয়িতা হলেন গাবতলীর নেপালতলী সুখানপুকুর চকডওর গ্রামের আব্দুর রাজ্জাকের স্ত্রী নুরজাহান বেগম। এসএসসি পাস করার পর ১৯৯৩ইং সালে তার বিয়ে হলে সংসার জীবনে জড়িয়ে পরেন সে। পরিবারে অর্থিক অবস্থা ভাল না হওয়ায় তিনি স্বামীকে নিয়ে ৫বিঘা জমিতে পুরোদমে কৃষি কাজ শুরু করেন। এরপরও সে থেমে থাাকেনি। নিজেই দারিদ্রকে জয় করতে মাঠের জমিতে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির মাধ্যমে বিষমুক্ত পেঁপে, আলু, কুমড়া, লাউ, শীম, টমেটো ও কপি’সহ সকল প্রকার সবজি চাষ করে বাজারে বিক্রি করতো সে। উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণের সহযোগিতায় তিনি প্রশিক্ষণ গ্রহন করে এলাকার মধ্যে একমাত্র সফল নারী কৃষক হিসাবে বেশ পরিচিতি লাভ করেন। এরপর সে অল্প সময়ের মধ্যে লাভবান হওয়ায় স্বাবলম্বী হন। বর্তমানে সে ৮বিঘা জমিতে সবজি চাষ করছে। এতে তার প্রতিবছরে ১৫লক্ষ টাকা আয় হয়। এখন তার অধীনে কৃষি খামারে প্রতিদিন কমপক্ষে ১০জন শ্রমিক দিনমজুরের কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করছে। ফলে পরিবার ফিরে পেয়েছে সুখের দিন। ফলে তার এ সকল কৃষি কাজ দেখে এলাকার অনেক নারী কৃষি কাজ করে পরিবারের অর্থিকভাবে সহায়তা করছে। তিনি দেশ ও মানুষের কল্যাণে এবং সমাজ সেবামূলক কাজ করার প্রত্যাশা ব্যক্ত করেন। জয়িতা অন্বেষনে ‘সফল জননী নারী’ ক্যাটাগরীতে নেপালতলী আমতলীপাড়া খিড়াপাড়া গ্রামের মৃত সোলেয়মান আলীর স্ত্রী মোছাঃ আশরাফুন নেছা নির্বাচিত হয়েছেন। তিনি জানান, আমি সুখানপুকুর উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ছিলাম। এখন অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক। আমার ৫পুত্র ও ৪কন্যা। নি¤œবৃত্ত পরিবারের সন্তান হওয়ায় বহু দুঃখ-কষ্টের মাঝে স্কুল পেড়িয়ে কলেজে বিএসসি পর্যন্ত লেখাপড়া করেছি। আমি আমার পিতার আদরের কন্যা সন্তান হওয়ায় মা-বাবা ও ভাই-বোন সবাইকে সহেযোগিতা করতে হতো। বাড়ীতে রান্না বান্না কাজ। এমনকি ঢেঁকিতে ধান-চাল ও আটা ভাঙ্গার কাজ করতে হতো। মূর্খ্য সমাজে লেখাপড়ার পাশাপাশি আমাকে ও পরিবারকে স্বাবলম্বী করতে জীবনে অনেক সংগ্রাম করতে হয়েছে। আমার বিবাহ হওয়ার পর সংসার জীবনে এসে শেষ পর্যন্ত সুখানপুকুর উচ্চ বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক হিসাবে যোগদান করি। এছাড়াও আমার কন্যা শাহিদা আকতার বগুড়া সরকারী আজিজুল হক বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ থেকে মাষ্টাস ডিগ্রি অর্জন করে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসাবে যোগদান করেছে। পুত্র শওকত জামান সৈয়দ আহম্মেদ কলেজে ভূগোল অনার্স পাস করার পর চাকুরীর জন্য চেষ্টা করছে। পুত্র আহসান হাবিব রাষ্ট্রবিজ্ঞানে মাষ্টাস পাশ করে ব্র্যাকে চাকুরী করছেন। ছোট কন্যা রুনা লায়লা বগুড়া আজিজুল হক কলেজে ইতিহাস অনার্স পাস করার পর সে নাড়–য়ামালা সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। ছোট পুত্র শহিদুল্লাহ বগুড়া আজিজুল হক কলেজে রসায়ন বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র। এছাড়াও কন্যা শামিমা আকতার এমএসসি, পুত্র মাহবুবুল এইচএসসি ও এরশাদ এইচএসসি পাস করে লেখাপাড়ার পাশাপাশি বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত রয়েছে। সবমিলিয়ে আমি আমার সন্তানদের নিয়ে আর্থিকভাবে স্বচ্ছলতা ও খুব সুখে দিন কাঁটাচ্ছি। ফলে এখন আশরাফুন নেছা’র পরিবারে সুদিনের বাতাস বইছে। অপরদিকে ‘নির্যাতনের বিভিষিকা মুছে ফেলে নতুন উদ্যেমে জীবন শুরু করেছে যে নারী’ ক্যাটাগরীতে শ্রেষ্ট জয়িতা হয়েছে গাবতলী পৌর এলাকার জয়ভোগা হাসনাপাড়া গ্রামের মৃত মহির উদ্দিনের কন্যা মোছাঃ শাহানুর আকতার। ২০১৩ইং সালে তাঁর বিয়ে হয়। এসএসসি পাশ করার পর বিবাহের ১থেকে ২মাসের মাথায় সংসারে নেমে আসে চরম দুরদিন ও হতাশা। পরিবারে সাংসারিক ঝগড়া কলহ চলতে থাকলে একপর্যায়ে তাঁর সংসার ভেঙ্গে যায়। ফিরে আসে পিতা-মাতার বাড়ীতে। সেখানে দরিদ্র ও অসহায় পিতার সংসারে নিজেকে অসহায় ও একাতীত্ব জীবনযাপন করতে থাকেন। এরপর শাহানুরের শুরু হয় সংগ্রামী জীবন। নিজেকে স্বাবলম্বী করতে শাহানুর ব্র্যাকের মানবাধিকার ও আইন সহায়তা কর্মসূচীতে সেবিকা হিসাবে কাজ করতে শুরু করে। এ কাজের পাশাপাশি সে যে অর্থ আয় করতেন সে টাকায় চলতো পিতা-মাতা ও তার সংসার। শাহানুর জানান, স্বামীর নির্যাতনের কথা মনে পড়লে ‘গাঁ’ জেন শিউড়ে উঠে। এরপরেও নিজের জীবনের ভবিষৎতের কথা চিন্তা করে পুরোনো দিন গুলো পিছনে ফেলে রেখে আত্মস্বাবলম্বী হওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন সে। ফলে নিজের পায়ে দাড়াতে আজ আমি সক্ষম হয়েছি। সুস্থ্য-সুন্দর জীবন গঠনে নির্যাতনের বিভিষিকা কে প্রজ্বোলিত করে আবারো নতুন উদ্যেমে জীবনটা কে শুরু করেছি। আশাকরছি জয়িতা অন্বেষনে আমাকে নির্বাচিত করায় আগামীদিনে আমার মত অনেক নির্যাতিত নারী দরিদ্র গ্রামীণ জনপথে নারীর ক্ষমতায়নে নতুন বিপ্লবের সূচনা হবে। সর্বশেষ ‘সমাজ উন্নয়নে অসামান্য অবদান রেখেছে যে নারী’ ক্যাটাগরীতে শ্রেষ্ট জয়িতা হন শামিমা আকতার নারগিছ। সে গাবতলী’র পদ্মপাড়া গ্রামের রুহুল আমিনের স্ত্রী। ১৯৯১ইং সালে বিবাহ হলে সে ১ছেলে-১কন্যার জননী হন। তাঁর সংসার জীবনে পরিশ্রম ও স্বামীর অর্থে সংসার চলতো। এরপরেও সে সমাজ ও জনকল্যাণ মূলক কাজ করার জন্য তিনি ১৯৯৫ইং সালে পদ্মপাড়া নারী কল্যাণ সমিতি গঠন করে। এছাড়াও গাবতলী সদর ইউপিতে ২০০৩ইং থেকে ২০১১ইং পর্যন্ত নারী ইউপি সদস্য নির্বাচিত হন। বর্তমানে ২এপ্রিল ২০১৬ইং সালে একই ইউপির নারী সদস্য পদে ২য়বার জয়লাভ করেন। বিভিন্ন সেবামূলক সংস্থা মাধ্যমে অসহায় বয়স্কদের নিরক্ষতা দূরীকরনে ভূমিকা রেখেছেন সে। অসহায় নারীদের সেলাই প্রশিক্ষণ প্রদান ও পুষ্টি প্রকল্প মাধ্যমে দুঃস্থ মহিলা ও শিশুদের পুষ্টিহীনতা দূরীকরন এবং স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করতে গনসচেতনতা সৃষ্টি করতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে আসছেন তিনি। এমনকি সে বিপদের সময় অসহায় গর্ভবতী নারীদের হাসপাতালে পাঠানো ও স্বাস্থ্য সেবা বিষয়ে তথ্যসেবা প্রদান করে আসছেন। শামিমা আকতার জানান, গরীব ছেলে-মেয়েদের বিবাহ, বাল্য-বহু বিবাহ রোধ, যৌতুক প্রতিরাধ, শিশু-মহিলা ও নারী নির্য়াতন প্রতিরোধ, কিশোর-শিশুদের স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিতকরন এবং মাদকাসক্তি বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সমাজে গনসচেতনতা সৃষ্টিতে কাজ করে আসছি। এমনকি নারীদের কে হাস-মুরগী পালন, সবজি চাষ ও কুঠির হস্ত-শিল্পের কাজে আগ্রহী করে তুলতে উৎসাহ প্রদান করে আসছি। এভাবে তিনি সরকারী-বেসরকারী সংস্থার মাধ্যমে সমাজের দরিদ্র নারীদের ও সমাজ উন্নয়নে কল্যাণমূখী কাজ করে সমাজের অগ্রণী ভূমিকা পালন করে আসচ্ছেন। জয়িতা অন্বেষনে বাংলাদেশ গাবতলী উপজেলা পযার্য়ে কমিটির আহবায়ক গাবতলী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ মনিরুজ্জামান জানান, জয়িতা অন্বেষনে চার ক্যাটাগরীতে চারজন কে নির্বাচিত করা হয়েছে। চার জনই সমাজ ও জনকল্যাণ মূলক কাজে ভিন্নভিন্ন ভাবে অবদান রয়েছে। সদস্য সচিব ও উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা মোঃ আশরাফ আলী জানান, কিছু সংখ্যক আবেদনের মধ্য যাচাই-বাচাই শেষে চার জনকে জয়িতা নির্বাচিত করা হয়েছে। আশাকরছি, নির্বাচিত বা বিজয়ী গাবতলীর চার জয়িতা আগামীদিনে সমাজ উন্নয়নে আরো গুরুত্বপূন্ন অগ্রণী ভূমিকা রাখবেন। এছাড়াও গাবতলী পৌরসভা’সহ ১১টি ইউনিয়নে অনেক প্রতিভা জয়িতা ছড়িয়া-ছিটিয়ে আছে। এদের প্রতিভা বিকাশে আমরা কাজ করে যাচ্ছি।