তাজরিন এখনো জানে না মা–বাবা, দাদা-দাদিকে একসঙ্গে হারিয়েছে সে

বজ্রপাতে আহত হয়ে তিন বছরের তাজরিন খাতুন যখন হাসপাতালে শুয়ে বাড়ি ফেরার অপেক্ষা করছে, তখন তাঁর বাড়িতে চলছে শোকের মাতম। একই ঘটনায় মৃত্যুবরণ করে বাড়ির সামনে সারি করে খোঁড়া কবরে ঠাঁই হয়েছে তাজরিনের মা–বাবা, দাদা-দাদি, ফুফু ও ফুফাতো ভাইয়ের। তবে এসবের কিছুই জানে না তাজরিন।

চাঁপাইনবাবগঞ্জের ২৫০ শয্যা শিষ্ট জেলা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন তাজরিন। আজ বৃহস্পতিবার দুপুরে সেখানে গেলে তার এক স্বজন বলেন, ‘তাকে আমরা এখনো জানাইনি। সে কিছু বুঝে উঠতেই পারেনি, সে কী হারিয়েছে!’

গতকাল বুধবার দুপুর ১২টার দিকে চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জে পদ্মা নদীর তেলিখাড়ি ঘাটে বজ্রপাতে ১৭ জনের মৃত্যু হয়। আহত হন অনেকে। তাঁরা সবাই বরযাত্রী ছিলেন। তাঁদের বাড়ি চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলায়। বৃষ্টিতে তেলিখাড়ি ঘাটের ছাউনির নিচে তাঁরা আশ্রয় নিয়েছিলেন।

তাজরিনের বাড়ি চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলার নারায়ণপুর ইউনিয়নের মহারাজনগর ডাইলপাড়া গ্রামে। তাঁর দাদার নাম মো. তোবজুল। তাঁদের বাড়ির মুখে বৃহস্পতিবার সকাল থেকেই ছিল মানুষের স্রোত। বাড়ির ভেতরে চলছিল নারীদের শোকের মাতম। অনেক মানুষ বাড়ির বাইরে দাঁড়িয়ে দেখছিল ছয় কবরের সারি। এখানেই বুধবার রাতে চিরনিদ্রায় শায়িত হয়েছেন মো. তোবজুল (৭০), তাঁর স্ত্রী জমিলা বেগম (৬০), ছেলে সাদেকুল ইসলাম ওরফে সাইদুল ইসলাম (৪০), সাইদুলের স্ত্রী টকিয়ারা বেগম (৩০), সাইদুলের বোন লেচন বেগম (৪৫) ও লেচনের ছেলে মো. বাবলু (২২)।

বৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে নয়টার দিকে গিয়ে দেখা যায়, ছয় কবরের সামনে নারী-পুরুষের ভিড়। বাড়ির ভেতরে বাড়ির নারীদের আহাজারি ঘিরে আত্মীয়স্বজনের ছোট ছোট জটলা। কান্নারত নারীদের সান্ত্বনা দিচ্ছেন তাঁরা। তাতে আরও বাড়ছে কান্নার রোল। বাড়িজুড়েই শোকের মাতম।

ভাইয়ের মেয়েকে বুকে জড়িয়ে রূপালী বেগমের আহাজারি। আজ বৃহস্পতিবার সকালে চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলার মহারাজনগর ডাইলপাড়া গ্রামে

ভাইয়ের মেয়েকে বুকে জড়িয়ে রূপালী বেগমের আহাজারি। আজ বৃহস্পতিবার সকালে চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলার মহারাজনগর ডাইলপাড়া গ্রামে 

রূপালী বেগম বজ্রপাতে নিহত ভাই সাদেকুল ইসলামের দুই মেয়েকে জড়িয়ে আহাজারি করছিলেন। কিছুতেই তাঁর কান্না থামাতে পারছিলেন না পাশে থাকা নারীরা। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার ভাই সাদেকুলের ছেলে মো. সিহাব (১৩), মেয়ে মোসা. সোনিয়া (১০), মোসা. তানিয়া (৮) ও তাজরিন খাতুন (৩)। এদের এখন কে দেখবে?’

নারীদের আর এক জটলায় গিয়ে দেখা যায়, বর মামুনের বোন সেলিনা খাতুন এক বছরের শিশু ছেলেকে কোলে নিয়ে চোখের জল ফেলছেন। কোলের শিশুটাও কেঁদে যাচ্ছে অনবরত। তাঁর তিন বছর বয়সী মেয়ে মায়ের দিকে চেয়ে আছে ফ্যালফ্যাল করে। সেলিনা বজ্রপাতে স্বামী মো. সোহবুলকে (৩৫) হারিয়েছেন। হারিয়েছেন বাবা, চাচা, চাচাতো ভাই, নানা, নানি, মামা, মামি, মামাতো ভাই, ফুফা, ফুফু, খালা, খালাতো ভাইকেও। তিনি বলেন, তিনিও ছিলেন ওই নৌকায়। নৌকা থেকে নেমে ঘাটের ওপরে একটি টিনের চালা ঘরের নিচে আশ্রয় নিয়েছিলেন। তখন বিকট শব্দে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। জ্ঞান ফিরতেই দেখেন মানুষজন তাঁর হাত-পা মালিশ করছেন। এরপর জানতে পারেন স্বামী, বাবা, ভাইসহ আত্মীয়স্বজন লাশ হয়ে গেছে।

আহাজারি করতে করতে সেলিনা খাতুন বলেন, ‘যারা গ্যালোত গ্যালোই। এখন আমরা যাঁরা বেঁচে আছি, তাঁরা একসঙ্গে এত আপনজন হারানোর শোক নিয়ে বাঁচব কীভাবে? আমার দুই শিশুসন্তান নিয়ে জীবন কাটবে কীভাবে?’

স্বামী, মা–বাবা, ভাই-ভাবি, বোন, ভাগনেসহ ১৫ আত্মীয়স্বজন হারিয়েছেন চেমালি বেগম। আজ বৃহস্পতিবার চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদরের  সূর্য্যনারায়ণপুর জনতার হাট গ্রামে

স্বামী, মা–বাবা, ভাই-ভাবি, বোন, ভাগনেসহ ১৫ আত্মীয়স্বজন হারিয়েছেন চেমালি বেগম। আজ বৃহস্পতিবার চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদরের সূর্য্যনারায়ণপুর জনতার হাট গ্রামে

সূর্য্যনারায়ণপুর জনতার হাট গ্রামে তোবজুলের নাতি বর মো. মামুনের বাড়িতে দুপুর পৌনে ১২টার দিকে গিয়ে দেখা যায়, আত্মীয়স্বজনের ভিড়। কথা বলার জন্য ঘর থেকে আঙিনায় ডাকা হয় মামুনকে। মা কোথায় জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, একই সঙ্গে স্বামী, মা–বাবা, ভাই-ভাবি, বোন, ভাগনেসহ ১৫ আত্মীয়স্বজন হারিয়ে তাঁর মাথা ঠিক নেই। হয়তো বাবার বাড়িতে গিয়ে ছয় কবরের সামনে বসে কাঁদছেন। এমন সময় মামুনের মা চেমালি বেগম বাড়িতে ঢুকেই কেঁদে কেঁদে বিলাপ করতে শুরু করেন। একে একে বলে যান স্বজনদের পরিচয়। একসময় অসুস্থ বোধ করতে থাকেন। বাড়ির বারান্দায় তাঁকে শুইয়ে দিয়ে মেয়েরা হাতপাখার বাতাস করতে থাকেন।

বাড়ির বাইরে গাছের ছায়ায় বিষণ্ন চেহারা নিয়ে বসেছিলেন মামুনের শ্বশুর শিবগঞ্জ উপজেলার পাঁকা ইউনিয়নের তেররশিয়া গ্রামের হোসেন আলী (৫৫)। তিনি বলেন, ‘বাড়িতে সব রান্নাবাড়া হচ্ছিল। পাকাভাত (পোলাও), গোসত রান্না সব শেষ। নাশতাপানিও রেডি। নিজের দিককার সব কুটুমরা চইল্যা আইস্যাছিল। জামাইয়ের দিককার কুটুম খালি আসতে বাকি। এর মধ্যেই শুননু ঘটনা। ক্ষণিকেই সব আয়োজন মাটি হইয়্যা গ্যাল। বিজলির এক আওয়াজেই সব আনন্দ শেষ!’

বজ্রপাতে এত এত মানুষ মারা যাচ্ছে। কিন্তু মানুষকে সচেতন করার জন্য প্রশাসনের বা স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের কোনো প্রচার নেই। মানুষকে কেউ বলার নেই যে বৃষ্টিবাদলে মেঘ ডাকলে নিরাপদ আশ্রয়ে থাকতে।

বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. সুজারুদ্দিন, মারা যাওয়া তোবজুলের ভগ্নিপতি

মামুনের বাড়ির অল্প দূরেই চাচা দুরুল হোদা ওরফে ধুলুর বাড়ি। বাড়ির সীমানার মধ্যেই কবর দিয়েছেন ছেলে মো. সজীবের (২২)। তিনিও ছিলেন একই নৌকার যাত্রী। দুরুল হোদা বলেন, ঘটনার পর মানুষকে বলেন লাশগুলো নৌকায় ওঠাতে সাহায্য করতে। কিন্তু তাঁরা হতবিহব্বল হয়ে দাঁড়িয়েই থাকেন। তখন নিজের ছেলেকে কোলে নিয়ে নৌকা রাখতে যান। এ সময় মানুষজনও লাশগুলো নৌকায় নিয়ে আসতে হাত লাগান।

তোবজুলের ভগ্নিপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. সুজারুদ্দিন (৬৫) প্রথম আলোকে বলেন, বজ্রপাতে একসঙ্গে এত লোকের মৃত্যুর কথা জীবনে শোনেননি তিনি। এখন বৃষ্টিবাদল বা মেঘ ডাকলেই বজ্রপাতে মৃত্যুর কথা শোনেন। আগে এমন ছিল না। তিনি বলেন, বজ্রপাতে এত এত মানুষ মারা যাচ্ছে। কিন্তু মানুষকে সচেতন করার জন্য প্রশাসনের বা স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের কোনো প্রচার নেই। মানুষকে কেউ বলার নেই যে বৃষ্টিবাদলে মেঘ ডাকলে নিরাপদ আশ্রয়ে থাকতে।

শিবগঞ্জ উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (পিআইও) আরিফুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় থেকে গত দুবছর থেকে জনগণেকে সচেতন করতে একটি লিফলেট পাঠানো হয়। তারা সেগুলো ইউনিয়ন পরিষদগুলোতে দিয়ে থাকে। কিন্তু সেগুলো ঠিকমতো মানুষের হাতে পৌঁছায় না। মানুষকে সচেতন করতে কার্যক্রম বলতে এটুকুই।

চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা হাসপাতালের জরুরি বিভাগ সূত্রে জানা যায়, বজ্রপাতে আহত হয়ে ১৬ জন ভর্তি হন। তাঁদের মধ্যে তামিম নামে এক শিশুকে পাঠানো হয় রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে।

Source: Prothomalo