দিব্যদৃষ্টি
বহুদিন ধরেই ভদ্রলোক অপেক্ষায় আছেন, একদিন নিজেই ব্রোকারেজ ব্যবসা চালু করবেন। আসল পয়সা সেখানেই। সেলস এজেন্ট হয়ে কত টাকাই–বা কমিশন আসে?
পেশাগত কারণেই আকরাম ভাই অতি ব্যস্ত সময় কাটান। তবে মাঝেমধ্যে তাঁর সঙ্গে এখানে–সেখানে দেখা হয়ে যায়। সেদিন যেমন দেখা হয়ে গেল একটি বাঙালি গ্রোসারি স্টোরে।
বিদেশে স্থায়ী হয়ে গেলেও জিব থেকে আমি বাঙালি স্বাদ সরাতে পারিনি। ঘি মাখানো দেশি টোস্ট বিস্কুট, দেশি চানাচুর ইত্যাদি থেকে শুরু করে দেশি নদী-হাওরের মাছ, দেশি মিষ্টির দোকানের তৈরি মিষ্টি ইত্যাদি খেতে ইচ্ছা হলেই এই গ্রোসারি স্টোরে হানা দিই। স্টোরের মালিক আমার বড় ভাইয়ের মতো, অতি কাছের মানুষ। তাদের ক্যাফেটেরিয়ায় সমুচা, শিঙারা, চা, বিরিয়ানি ইত্যাদি পাওয়া যায়। সঙ্গে পাওয়া যায় মুরগির কিমা দিয়ে তৈরি চিকেন ললিপপ। আমার সাড়ে চার বছর বয়সী ছেলে আবার এ বিশেষ খাবারের একনিষ্ঠ ভক্ত। এ দোকানে এলেই সে বায়না ধরে চিকেন ললিপপের। আগে ওকে দু–তিনটা কিনে দিই, তারপরে ও খেতে থাকে আর আমরা বাজার শুরু করি।
এই চিকেন ললিপপ কিনতে গিয়েই আকরাম ভাইয়ের সঙ্গে দেখা। তিন–চার মাস পরে তো অবশ্যই। স্বভাবসুলভ উৎফুল্ল কণ্ঠে তিনি বলে উঠলেন, ‘আরে তুমি যে! কী খবর? অনেক দিন কোনো খোঁজ নেই!’
চা আর প্যাটিস হাতে আমরা আড্ডায় বসে গেলাম। এটা-সেটা নানা বিষয়ে কথা হলো। এর–ওর খোঁজ নেওয়া হলো। তারপর কথা থেকে কথার সূত্র ধরে ধরেই তিনি বললেন, ‘তুমি অলৌকিকতায় বিশ্বাস করো?’
‘সেবার আমি আমেরিকা আসার পরে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশে বেড়াতে গেছি। এক বছরের মাথাতেই। দেশকে পাগলের মতো মিস করি। বন্ধুদের আড্ডা, শহরের কোলাহল, দোকানের খাবার সবকিছুর জন্য মন হাহাকার করে ওঠে। এয়ারপোর্ট থেকে বাড়িতে গিয়ে লাগেজ নামিয়েই বেরিয়ে গিয়েছিলাম বন্ধুবান্ধব নিয়ে আনোয়ারের দোকানে চা খেতে খেতে আড্ডা দিতে। সঙ্গে গরম-গরম তেলে ভাজা ধোঁয়া ওঠা শিঙারা। আনোয়ার করত কী, শিঙাড়ার সঙ্গে টমেটো সসের বদলে কাসুন্দির মতো ঝাঁজালো শর্ষের একটা সস দিত। ইশ্! যদি একবার কাঁচা পেঁয়াজ আর সেই সস দিয়ে শিঙারা খেতে, তাহলে বুঝতে কী অমৃত যে লাগত! এ দেশে বাংলাদেশি স্টাইলে শিঙারা কেউ বানায় না। সবাই ইন্ডিয়ান গ্রাহক পেতে ইন্ডিয়ান শিঙারা বানায়। ওটা মুখে দেওয়া যায়?’
আমি মাথা নেড়ে সায় দিলাম। বাস্তবেই, যে বাঙালি শিঙাড়ায় অভ্যস্ত, তাঁর কাছে পাঞ্জাবি শিঙারা ভালো লাগার কথা না।
‘প্রথম দিনই ফুড পয়জনিং হয়ে গেল। এতটাই খারাপ অবস্থা যে এক রাত হাসপাতালে কাটাতে হয়েছিল। মনে মনে হাসছিলাম। আমার দেশি পেট বুঝি নিজেকে ইংরেজ ভাবতে শুরু করেছিল, তাই বাঙালি খাবার পেটে যেতেই বিদ্রোহ করেছে। হা হা হা।’
আমিও হাসলাম। প্রতিটা প্রবাসীর দেশে গেলে এই যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। অতি সাবধানে খাওয়াদাওয়া করতে হয়। একটু পান থেকে চুন খসলেই খাঁটি ভেজালমুক্ত খাবারে অভ্যস্ত হয়ে যাওয়া পাকস্থলী তখন দ্রোহী হয়ে ওঠে।
‘সুস্থ হওয়ার পরে ছুটলাম পুরান ঢাকার দিকে। বিরিয়ানি খেতে হবে। মাত্র এক মাসের জন্য গেছি বেড়াতে। সময় একদমই নেই। পেট খারাপ হলে হবে, ওষুধ খেয়ে ঠিক করা যাবে। ডালাসে আমাকে নান্না আর হাজির বিরিয়ানি কে এনে দেবে?’
কথা ঠিক। আমি নিজেও দেশে গেলে পুরান ঢাকায় ছুটি। দেশি খাবারের কারোর স্মৃতিচারণাও আমার জিবে জল নিয়ে আসে, যেমনটা এখন আনল। তিনি বর্ণনাও শুরু করেননি, অথচ আমি ঠিক চোখের সামনে দেখলাম বিরাট লাইন অতিক্রম করে আমি হাজি সাহেবের রেস্তোরাঁ বসার সুযোগ পেয়েছি। আমার সামনে এক প্লেট গরম-গরম বিরিয়ানি রাখা হয়েছে। তা থেকে ভেসে আসছে শর্ষের তেলে ভাজা খাসির মাংসের ঘ্রাণ! সঙ্গে সালাদ হিসেবে কিছু শসা, মরিচ আর টমেটো। এক গ্লাস বোরহানি এনে এই মাত্র রাখল পাশে। টেবিলে গ্লাস রাখার শব্দটাও যেন স্পষ্ট শুনতে পেলাম। আহ্!
‘গুলিস্তান মোড়ে পৌঁছে রিকশা নিলাম, আমি আর আমার বন্ধু ইলিয়াস। জসিম আর সুজনও আছে আমাদের সঙ্গী, তবে ওরা অন্য রিকশায় চেপেছে। আমরা চারজন একদম নার্সারি ওয়ান থেকে বন্ধু। স্কুল, কলেজ, ইউনিভার্সিটি সব একসঙ্গে। তাই খুব হইহুল্লোড় করতে করতে যাচ্ছি। বয়স ছিল তরুণ, মন ছিল নির্ভার এবং ফুর্তিতে ভরপুর। বুঝতেই পারছ।’
আমি বুঝতে পারছি। একই বয়স আমিও কাটিয়ে এসেছি।
‘তা হঠাৎই আমার মনে হলো রিকশার গতি বাড়তে শুরু করেছে। অস্বাভাবিক হারে বাড়ছে। আশপাশের সবকিছু হঠাৎ শ্লথ হয়ে গেছে, আমাদের রিকশাই কেবল বাতাসের বাধা কেটে উল্কার বেগে সামনের দিকে ছুটছে। হাওয়ার চাপে আমি তখন টিকে থাকতে পারছি না। মনে হচ্ছে, এই বুঝবি রিকশা থেকে ছিটকে পড়ব। অথবা উড়েই যাব! শিউরে উঠলাম। ইলিয়াসের হাত ধরতে যাব, কিন্তু পাশে দেখি সে নেই। সামনে রিকশাওয়ালাও গায়েব হয়ে গেল। রিকশা আপনাতেই দুরন্ত বেগে ছুটছে। আমি চিৎকার দিতে চাইলাম, মুখ থেকে শব্দও বেরোল, কিন্তু বাতাস সে শব্দ ঠেলে পেছনে নিয়ে গেল। যেন রিকশা না, আমি কোনো রকেটের ছাদে বসে আছি। আমি নিজেকে সামলাতে পারছি না। রিকশার হুড চেপে ধরে আছি। চোখ খুলে রাখতে কষ্ট হচ্ছে। বন্ধ করতে সাহস পাচ্ছি না। কোথায় না কোথায় গিয়ে আছড়ে পড়ি! রিকশা থেকে লাফ দেব, সে উপায়ও নেই। আমার শরীর পুরোপুরি অবশ তখন। সিটের সঙ্গে যেন গেঁথে গেছি।
‘যেভাবে হঠাৎই রিকশা চলতে শুরু করেছিল, ঠিক সেভাবেই হঠাৎই থেমে গেল। আমার হার্টবিট তখন ২০০ থেকে ৩০০ হবে নিশ্চিত। হৃৎপিণ্ড যে ফেটে যায়নি, সেটাই বিস্ময়কর। খানিকটা স্থির হয়ে আমি যখন আশপাশে চোখ বুলাই, দেখি আমি এক সম্পূর্ণ অন্য জগতে চলে এসেছি। আমি একটি করিডরের মাঝে দাঁড়িয়ে আছি। আমার দুপাশে ধবধবে সাদা দেয়াল যেন আকাশ ফুঁড়ে দাঁড়িয়ে আছে। ওপর চোখ তুলে ছাদ বোঝার চেষ্টা করলাম, সম্ভব হলো না। অসীমে, যেখানে চোখের দৃষ্টিও হার মানে, আমি দেখলাম দেয়াল তখনো কেবল উঠছেই। আর সামনে–পেছনেও কোথা থেকে শুরু হয়ে কোথায় গিয়ে শেষ হয়েছে, কিছুই বুঝতে পারছি না। সবচেয়ে অদ্ভুত হচ্ছে আমি আলো দেখতে পাচ্ছি, কিন্তু আলোর উৎস খুঁজে পাচ্ছি না। দেয়ালে কোনো লাইট–বাল্ব নেই, কিন্তু পুরো করিডর ভেসে যাচ্ছে স্থির আলোর বন্যায়। সবচেয়ে অদ্ভুত হচ্ছে, আমার ছায়া আমি দেখতে পারছি না। ধবধবে সাদা মেঝের কোথাও আমার বা রিকশার ছায়া নেই।
চা আর প্যাটিস হাতে আমরা আড্ডায় বসে গেলাম। এটা-সেটা নানা বিষয়ে কথা হলো। এর–ওর খোঁজ নেওয়া হলো। তারপর কথা থেকে কথার সূত্র ধরে ধরেই তিনি বললেন, ‘তুমি অলৌকিকতায় বিশ্বাস করো?’
‘সেবার আমি আমেরিকা আসার পরে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশে বেড়াতে গেছি। এক বছরের মাথাতেই। দেশকে পাগলের মতো মিস করি। বন্ধুদের আড্ডা, শহরের কোলাহল, দোকানের খাবার সবকিছুর জন্য মন হাহাকার করে ওঠে। এয়ারপোর্ট থেকে বাড়িতে গিয়ে লাগেজ নামিয়েই বেরিয়ে গিয়েছিলাম বন্ধুবান্ধব নিয়ে আনোয়ারের দোকানে চা খেতে খেতে আড্ডা দিতে। সঙ্গে গরম-গরম তেলে ভাজা ধোঁয়া ওঠা শিঙারা। আনোয়ার করত কী, শিঙাড়ার সঙ্গে টমেটো সসের বদলে কাসুন্দির মতো ঝাঁজালো শর্ষের একটা সস দিত। ইশ্! যদি একবার কাঁচা পেঁয়াজ আর সেই সস দিয়ে শিঙারা খেতে, তাহলে বুঝতে কী অমৃত যে লাগত! এ দেশে বাংলাদেশি স্টাইলে শিঙারা কেউ বানায় না। সবাই ইন্ডিয়ান গ্রাহক পেতে ইন্ডিয়ান শিঙারা বানায়। ওটা মুখে দেওয়া যায়?’
আমি মাথা নেড়ে সায় দিলাম। বাস্তবেই, যে বাঙালি শিঙাড়ায় অভ্যস্ত, তাঁর কাছে পাঞ্জাবি শিঙারা ভালো লাগার কথা না।
‘প্রথম দিনই ফুড পয়জনিং হয়ে গেল। এতটাই খারাপ অবস্থা যে এক রাত হাসপাতালে কাটাতে হয়েছিল। মনে মনে হাসছিলাম। আমার দেশি পেট বুঝি নিজেকে ইংরেজ ভাবতে শুরু করেছিল, তাই বাঙালি খাবার পেটে যেতেই বিদ্রোহ করেছে। হা হা হা।’
আমিও হাসলাম। প্রতিটা প্রবাসীর দেশে গেলে এই যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। অতি সাবধানে খাওয়াদাওয়া করতে হয়। একটু পান থেকে চুন খসলেই খাঁটি ভেজালমুক্ত খাবারে অভ্যস্ত হয়ে যাওয়া পাকস্থলী তখন দ্রোহী হয়ে ওঠে।
‘সুস্থ হওয়ার পরে ছুটলাম পুরান ঢাকার দিকে। বিরিয়ানি খেতে হবে। মাত্র এক মাসের জন্য গেছি বেড়াতে। সময় একদমই নেই। পেট খারাপ হলে হবে, ওষুধ খেয়ে ঠিক করা যাবে। ডালাসে আমাকে নান্না আর হাজির বিরিয়ানি কে এনে দেবে?’
কথা ঠিক। আমি নিজেও দেশে গেলে পুরান ঢাকায় ছুটি। দেশি খাবারের কারোর স্মৃতিচারণাও আমার জিবে জল নিয়ে আসে, যেমনটা এখন আনল। তিনি বর্ণনাও শুরু করেননি, অথচ আমি ঠিক চোখের সামনে দেখলাম বিরাট লাইন অতিক্রম করে আমি হাজি সাহেবের রেস্তোরাঁ বসার সুযোগ পেয়েছি। আমার সামনে এক প্লেট গরম-গরম বিরিয়ানি রাখা হয়েছে। তা থেকে ভেসে আসছে শর্ষের তেলে ভাজা খাসির মাংসের ঘ্রাণ! সঙ্গে সালাদ হিসেবে কিছু শসা, মরিচ আর টমেটো। এক গ্লাস বোরহানি এনে এই মাত্র রাখল পাশে। টেবিলে গ্লাস রাখার শব্দটাও যেন স্পষ্ট শুনতে পেলাম। আহ্!
‘গুলিস্তান মোড়ে পৌঁছে রিকশা নিলাম, আমি আর আমার বন্ধু ইলিয়াস। জসিম আর সুজনও আছে আমাদের সঙ্গী, তবে ওরা অন্য রিকশায় চেপেছে। আমরা চারজন একদম নার্সারি ওয়ান থেকে বন্ধু। স্কুল, কলেজ, ইউনিভার্সিটি সব একসঙ্গে। তাই খুব হইহুল্লোড় করতে করতে যাচ্ছি। বয়স ছিল তরুণ, মন ছিল নির্ভার এবং ফুর্তিতে ভরপুর। বুঝতেই পারছ।’
আমি বুঝতে পারছি। একই বয়স আমিও কাটিয়ে এসেছি।
‘তা হঠাৎই আমার মনে হলো রিকশার গতি বাড়তে শুরু করেছে। অস্বাভাবিক হারে বাড়ছে। আশপাশের সবকিছু হঠাৎ শ্লথ হয়ে গেছে, আমাদের রিকশাই কেবল বাতাসের বাধা কেটে উল্কার বেগে সামনের দিকে ছুটছে। হাওয়ার চাপে আমি তখন টিকে থাকতে পারছি না। মনে হচ্ছে, এই বুঝবি রিকশা থেকে ছিটকে পড়ব। অথবা উড়েই যাব! শিউরে উঠলাম। ইলিয়াসের হাত ধরতে যাব, কিন্তু পাশে দেখি সে নেই। সামনে রিকশাওয়ালাও গায়েব হয়ে গেল। রিকশা আপনাতেই দুরন্ত বেগে ছুটছে। আমি চিৎকার দিতে চাইলাম, মুখ থেকে শব্দও বেরোল, কিন্তু বাতাস সে শব্দ ঠেলে পেছনে নিয়ে গেল। যেন রিকশা না, আমি কোনো রকেটের ছাদে বসে আছি। আমি নিজেকে সামলাতে পারছি না। রিকশার হুড চেপে ধরে আছি। চোখ খুলে রাখতে কষ্ট হচ্ছে। বন্ধ করতে সাহস পাচ্ছি না। কোথায় না কোথায় গিয়ে আছড়ে পড়ি! রিকশা থেকে লাফ দেব, সে উপায়ও নেই। আমার শরীর পুরোপুরি অবশ তখন। সিটের সঙ্গে যেন গেঁথে গেছি।
‘যেভাবে হঠাৎই রিকশা চলতে শুরু করেছিল, ঠিক সেভাবেই হঠাৎই থেমে গেল। আমার হার্টবিট তখন ২০০ থেকে ৩০০ হবে নিশ্চিত। হৃৎপিণ্ড যে ফেটে যায়নি, সেটাই বিস্ময়কর। খানিকটা স্থির হয়ে আমি যখন আশপাশে চোখ বুলাই, দেখি আমি এক সম্পূর্ণ অন্য জগতে চলে এসেছি। আমি একটি করিডরের মাঝে দাঁড়িয়ে আছি। আমার দুপাশে ধবধবে সাদা দেয়াল যেন আকাশ ফুঁড়ে দাঁড়িয়ে আছে। ওপর চোখ তুলে ছাদ বোঝার চেষ্টা করলাম, সম্ভব হলো না। অসীমে, যেখানে চোখের দৃষ্টিও হার মানে, আমি দেখলাম দেয়াল তখনো কেবল উঠছেই। আর সামনে–পেছনেও কোথা থেকে শুরু হয়ে কোথায় গিয়ে শেষ হয়েছে, কিছুই বুঝতে পারছি না। সবচেয়ে অদ্ভুত হচ্ছে আমি আলো দেখতে পাচ্ছি, কিন্তু আলোর উৎস খুঁজে পাচ্ছি না। দেয়ালে কোনো লাইট–বাল্ব নেই, কিন্তু পুরো করিডর ভেসে যাচ্ছে স্থির আলোর বন্যায়। সবচেয়ে অদ্ভুত হচ্ছে, আমার ছায়া আমি দেখতে পারছি না। ধবধবে সাদা মেঝের কোথাও আমার বা রিকশার ছায়া নেই।
চা আর প্যাটিস হাতে আমরা আড্ডায় বসে গেলাম। এটা-সেটা নানা বিষয়ে কথা হলো। এর–ওর খোঁজ নেওয়া হলো। তারপর কথা থেকে কথার সূত্র ধরে ধরেই তিনি বললেন, ‘তুমি অলৌকিকতায় বিশ্বাস করো?’
‘সেবার আমি আমেরিকা আসার পরে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশে বেড়াতে গেছি। এক বছরের মাথাতেই। দেশকে পাগলের মতো মিস করি। বন্ধুদের আড্ডা, শহরের কোলাহল, দোকানের খাবার সবকিছুর জন্য মন হাহাকার করে ওঠে। এয়ারপোর্ট থেকে বাড়িতে গিয়ে লাগেজ নামিয়েই বেরিয়ে গিয়েছিলাম বন্ধুবান্ধব নিয়ে আনোয়ারের দোকানে চা খেতে খেতে আড্ডা দিতে। সঙ্গে গরম-গরম তেলে ভাজা ধোঁয়া ওঠা শিঙারা। আনোয়ার করত কী, শিঙাড়ার সঙ্গে টমেটো সসের বদলে কাসুন্দির মতো ঝাঁজালো শর্ষের একটা সস দিত। ইশ্! যদি একবার কাঁচা পেঁয়াজ আর সেই সস দিয়ে শিঙারা খেতে, তাহলে বুঝতে কী অমৃত যে লাগত! এ দেশে বাংলাদেশি স্টাইলে শিঙারা কেউ বানায় না। সবাই ইন্ডিয়ান গ্রাহক পেতে ইন্ডিয়ান শিঙারা বানায়। ওটা মুখে দেওয়া যায়?’
আমি মাথা নেড়ে সায় দিলাম। বাস্তবেই, যে বাঙালি শিঙাড়ায় অভ্যস্ত, তাঁর কাছে পাঞ্জাবি শিঙারা ভালো লাগার কথা না।
‘প্রথম দিনই ফুড পয়জনিং হয়ে গেল। এতটাই খারাপ অবস্থা যে এক রাত হাসপাতালে কাটাতে হয়েছিল। মনে মনে হাসছিলাম। আমার দেশি পেট বুঝি নিজেকে ইংরেজ ভাবতে শুরু করেছিল, তাই বাঙালি খাবার পেটে যেতেই বিদ্রোহ করেছে। হা হা হা।’
আমিও হাসলাম। প্রতিটা প্রবাসীর দেশে গেলে এই যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। অতি সাবধানে খাওয়াদাওয়া করতে হয়। একটু পান থেকে চুন খসলেই খাঁটি ভেজালমুক্ত খাবারে অভ্যস্ত হয়ে যাওয়া পাকস্থলী তখন দ্রোহী হয়ে ওঠে।
‘সুস্থ হওয়ার পরে ছুটলাম পুরান ঢাকার দিকে। বিরিয়ানি খেতে হবে। মাত্র এক মাসের জন্য গেছি বেড়াতে। সময় একদমই নেই। পেট খারাপ হলে হবে, ওষুধ খেয়ে ঠিক করা যাবে। ডালাসে আমাকে নান্না আর হাজির বিরিয়ানি কে এনে দেবে?’
কথা ঠিক। আমি নিজেও দেশে গেলে পুরান ঢাকায় ছুটি। দেশি খাবারের কারোর স্মৃতিচারণাও আমার জিবে জল নিয়ে আসে, যেমনটা এখন আনল। তিনি বর্ণনাও শুরু করেননি, অথচ আমি ঠিক চোখের সামনে দেখলাম বিরাট লাইন অতিক্রম করে আমি হাজি সাহেবের রেস্তোরাঁ বসার সুযোগ পেয়েছি। আমার সামনে এক প্লেট গরম-গরম বিরিয়ানি রাখা হয়েছে। তা থেকে ভেসে আসছে শর্ষের তেলে ভাজা খাসির মাংসের ঘ্রাণ! সঙ্গে সালাদ হিসেবে কিছু শসা, মরিচ আর টমেটো। এক গ্লাস বোরহানি এনে এই মাত্র রাখল পাশে। টেবিলে গ্লাস রাখার শব্দটাও যেন স্পষ্ট শুনতে পেলাম। আহ্!
‘গুলিস্তান মোড়ে পৌঁছে রিকশা নিলাম, আমি আর আমার বন্ধু ইলিয়াস। জসিম আর সুজনও আছে আমাদের সঙ্গী, তবে ওরা অন্য রিকশায় চেপেছে। আমরা চারজন একদম নার্সারি ওয়ান থেকে বন্ধু। স্কুল, কলেজ, ইউনিভার্সিটি সব একসঙ্গে। তাই খুব হইহুল্লোড় করতে করতে যাচ্ছি। বয়স ছিল তরুণ, মন ছিল নির্ভার এবং ফুর্তিতে ভরপুর। বুঝতেই পারছ।’
আমি বুঝতে পারছি। একই বয়স আমিও কাটিয়ে এসেছি।
‘তা হঠাৎই আমার মনে হলো রিকশার গতি বাড়তে শুরু করেছে। অস্বাভাবিক হারে বাড়ছে। আশপাশের সবকিছু হঠাৎ শ্লথ হয়ে গেছে, আমাদের রিকশাই কেবল বাতাসের বাধা কেটে উল্কার বেগে সামনের দিকে ছুটছে। হাওয়ার চাপে আমি তখন টিকে থাকতে পারছি না। মনে হচ্ছে, এই বুঝবি রিকশা থেকে ছিটকে পড়ব। অথবা উড়েই যাব! শিউরে উঠলাম। ইলিয়াসের হাত ধরতে যাব, কিন্তু পাশে দেখি সে নেই। সামনে রিকশাওয়ালাও গায়েব হয়ে গেল। রিকশা আপনাতেই দুরন্ত বেগে ছুটছে। আমি চিৎকার দিতে চাইলাম, মুখ থেকে শব্দও বেরোল, কিন্তু বাতাস সে শব্দ ঠেলে পেছনে নিয়ে গেল। যেন রিকশা না, আমি কোনো রকেটের ছাদে বসে আছি। আমি নিজেকে সামলাতে পারছি না। রিকশার হুড চেপে ধরে আছি। চোখ খুলে রাখতে কষ্ট হচ্ছে। বন্ধ করতে সাহস পাচ্ছি না। কোথায় না কোথায় গিয়ে আছড়ে পড়ি! রিকশা থেকে লাফ দেব, সে উপায়ও নেই। আমার শরীর পুরোপুরি অবশ তখন। সিটের সঙ্গে যেন গেঁথে গেছি।
‘যেভাবে হঠাৎই রিকশা চলতে শুরু করেছিল, ঠিক সেভাবেই হঠাৎই থেমে গেল। আমার হার্টবিট তখন ২০০ থেকে ৩০০ হবে নিশ্চিত। হৃৎপিণ্ড যে ফেটে যায়নি, সেটাই বিস্ময়কর। খানিকটা স্থির হয়ে আমি যখন আশপাশে চোখ বুলাই, দেখি আমি এক সম্পূর্ণ অন্য জগতে চলে এসেছি। আমি একটি করিডরের মাঝে দাঁড়িয়ে আছি। আমার দুপাশে ধবধবে সাদা দেয়াল যেন আকাশ ফুঁড়ে দাঁড়িয়ে আছে। ওপর চোখ তুলে ছাদ বোঝার চেষ্টা করলাম, সম্ভব হলো না। অসীমে, যেখানে চোখের দৃষ্টিও হার মানে, আমি দেখলাম দেয়াল তখনো কেবল উঠছেই। আর সামনে–পেছনেও কোথা থেকে শুরু হয়ে কোথায় গিয়ে শেষ হয়েছে, কিছুই বুঝতে পারছি না। সবচেয়ে অদ্ভুত হচ্ছে আমি আলো দেখতে পাচ্ছি, কিন্তু আলোর উৎস খুঁজে পাচ্ছি না। দেয়ালে কোনো লাইট–বাল্ব নেই, কিন্তু পুরো করিডর ভেসে যাচ্ছে স্থির আলোর বন্যায়। সবচেয়ে অদ্ভুত হচ্ছে, আমার ছায়া আমি দেখতে পারছি না। ধবধবে সাদা মেঝের কোথাও আমার বা রিকশার ছায়া নেই।
চা আর প্যাটিস হাতে আমরা আড্ডায় বসে গেলাম। এটা-সেটা নানা বিষয়ে কথা হলো। এর–ওর খোঁজ নেওয়া হলো। তারপর কথা থেকে কথার সূত্র ধরে ধরেই তিনি বললেন, ‘তুমি অলৌকিকতায় বিশ্বাস করো?’
‘সেবার আমি আমেরিকা আসার পরে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশে বেড়াতে গেছি। এক বছরের মাথাতেই। দেশকে পাগলের মতো মিস করি। বন্ধুদের আড্ডা, শহরের কোলাহল, দোকানের খাবার সবকিছুর জন্য মন হাহাকার করে ওঠে। এয়ারপোর্ট থেকে বাড়িতে গিয়ে লাগেজ নামিয়েই বেরিয়ে গিয়েছিলাম বন্ধুবান্ধব নিয়ে আনোয়ারের দোকানে চা খেতে খেতে আড্ডা দিতে। সঙ্গে গরম-গরম তেলে ভাজা ধোঁয়া ওঠা শিঙারা। আনোয়ার করত কী, শিঙাড়ার সঙ্গে টমেটো সসের বদলে কাসুন্দির মতো ঝাঁজালো শর্ষের একটা সস দিত। ইশ্! যদি একবার কাঁচা পেঁয়াজ আর সেই সস দিয়ে শিঙারা খেতে, তাহলে বুঝতে কী অমৃত যে লাগত! এ দেশে বাংলাদেশি স্টাইলে শিঙারা কেউ বানায় না। সবাই ইন্ডিয়ান গ্রাহক পেতে ইন্ডিয়ান শিঙারা বানায়। ওটা মুখে দেওয়া যায়?’
আমি মাথা নেড়ে সায় দিলাম। বাস্তবেই, যে বাঙালি শিঙাড়ায় অভ্যস্ত, তাঁর কাছে পাঞ্জাবি শিঙারা ভালো লাগার কথা না।
‘প্রথম দিনই ফুড পয়জনিং হয়ে গেল। এতটাই খারাপ অবস্থা যে এক রাত হাসপাতালে কাটাতে হয়েছিল। মনে মনে হাসছিলাম। আমার দেশি পেট বুঝি নিজেকে ইংরেজ ভাবতে শুরু করেছিল, তাই বাঙালি খাবার পেটে যেতেই বিদ্রোহ করেছে। হা হা হা।’
আমিও হাসলাম। প্রতিটা প্রবাসীর দেশে গেলে এই যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। অতি সাবধানে খাওয়াদাওয়া করতে হয়। একটু পান থেকে চুন খসলেই খাঁটি ভেজালমুক্ত খাবারে অভ্যস্ত হয়ে যাওয়া পাকস্থলী তখন দ্রোহী হয়ে ওঠে।
‘সুস্থ হওয়ার পরে ছুটলাম পুরান ঢাকার দিকে। বিরিয়ানি খেতে হবে। মাত্র এক মাসের জন্য গেছি বেড়াতে। সময় একদমই নেই। পেট খারাপ হলে হবে, ওষুধ খেয়ে ঠিক করা যাবে। ডালাসে আমাকে নান্না আর হাজির বিরিয়ানি কে এনে দেবে?’
কথা ঠিক। আমি নিজেও দেশে গেলে পুরান ঢাকায় ছুটি। দেশি খাবারের কারোর স্মৃতিচারণাও আমার জিবে জল নিয়ে আসে, যেমনটা এখন আনল। তিনি বর্ণনাও শুরু করেননি, অথচ আমি ঠিক চোখের সামনে দেখলাম বিরাট লাইন অতিক্রম করে আমি হাজি সাহেবের রেস্তোরাঁ বসার সুযোগ পেয়েছি। আমার সামনে এক প্লেট গরম-গরম বিরিয়ানি রাখা হয়েছে। তা থেকে ভেসে আসছে শর্ষের তেলে ভাজা খাসির মাংসের ঘ্রাণ! সঙ্গে সালাদ হিসেবে কিছু শসা, মরিচ আর টমেটো। এক গ্লাস বোরহানি এনে এই মাত্র রাখল পাশে। টেবিলে গ্লাস রাখার শব্দটাও যেন স্পষ্ট শুনতে পেলাম। আহ্!
‘গুলিস্তান মোড়ে পৌঁছে রিকশা নিলাম, আমি আর আমার বন্ধু ইলিয়াস। জসিম আর সুজনও আছে আমাদের সঙ্গী, তবে ওরা অন্য রিকশায় চেপেছে। আমরা চারজন একদম নার্সারি ওয়ান থেকে বন্ধু। স্কুল, কলেজ, ইউনিভার্সিটি সব একসঙ্গে। তাই খুব হইহুল্লোড় করতে করতে যাচ্ছি। বয়স ছিল তরুণ, মন ছিল নির্ভার এবং ফুর্তিতে ভরপুর। বুঝতেই পারছ।’
আমি বুঝতে পারছি। একই বয়স আমিও কাটিয়ে এসেছি।
‘তা হঠাৎই আমার মনে হলো রিকশার গতি বাড়তে শুরু করেছে। অস্বাভাবিক হারে বাড়ছে। আশপাশের সবকিছু হঠাৎ শ্লথ হয়ে গেছে, আমাদের রিকশাই কেবল বাতাসের বাধা কেটে উল্কার বেগে সামনের দিকে ছুটছে। হাওয়ার চাপে আমি তখন টিকে থাকতে পারছি না। মনে হচ্ছে, এই বুঝবি রিকশা থেকে ছিটকে পড়ব। অথবা উড়েই যাব! শিউরে উঠলাম। ইলিয়াসের হাত ধরতে যাব, কিন্তু পাশে দেখি সে নেই। সামনে রিকশাওয়ালাও গায়েব হয়ে গেল। রিকশা আপনাতেই দুরন্ত বেগে ছুটছে। আমি চিৎকার দিতে চাইলাম, মুখ থেকে শব্দও বেরোল, কিন্তু বাতাস সে শব্দ ঠেলে পেছনে নিয়ে গেল। যেন রিকশা না, আমি কোনো রকেটের ছাদে বসে আছি। আমি নিজেকে সামলাতে পারছি না। রিকশার হুড চেপে ধরে আছি। চোখ খুলে রাখতে কষ্ট হচ্ছে। বন্ধ করতে সাহস পাচ্ছি না। কোথায় না কোথায় গিয়ে আছড়ে পড়ি! রিকশা থেকে লাফ দেব, সে উপায়ও নেই। আমার শরীর পুরোপুরি অবশ তখন। সিটের সঙ্গে যেন গেঁথে গেছি।
‘যেভাবে হঠাৎই রিকশা চলতে শুরু করেছিল, ঠিক সেভাবেই হঠাৎই থেমে গেল। আমার হার্টবিট তখন ২০০ থেকে ৩০০ হবে নিশ্চিত। হৃৎপিণ্ড যে ফেটে যায়নি, সেটাই বিস্ময়কর। খানিকটা স্থির হয়ে আমি যখন আশপাশে চোখ বুলাই, দেখি আমি এক সম্পূর্ণ অন্য জগতে চলে এসেছি। আমি একটি করিডরের মাঝে দাঁড়িয়ে আছি। আমার দুপাশে ধবধবে সাদা দেয়াল যেন আকাশ ফুঁড়ে দাঁড়িয়ে আছে। ওপর চোখ তুলে ছাদ বোঝার চেষ্টা করলাম, সম্ভব হলো না। অসীমে, যেখানে চোখের দৃষ্টিও হার মানে, আমি দেখলাম দেয়াল তখনো কেবল উঠছেই। আর সামনে–পেছনেও কোথা থেকে শুরু হয়ে কোথায় গিয়ে শেষ হয়েছে, কিছুই বুঝতে পারছি না। সবচেয়ে অদ্ভুত হচ্ছে আমি আলো দেখতে পাচ্ছি, কিন্তু আলোর উৎস খুঁজে পাচ্ছি না। দেয়ালে কোনো লাইট–বাল্ব নেই, কিন্তু পুরো করিডর ভেসে যাচ্ছে স্থির আলোর বন্যায়। সবচেয়ে অদ্ভুত হচ্ছে, আমার ছায়া আমি দেখতে পারছি না। ধবধবে সাদা মেঝের কোথাও আমার বা রিকশার ছায়া নেই।
‘আমি ছুটলাম ঢাকার উদ্দেশে। আসতে আসতে মঙ্গলবার হয়ে গেল। সুজনের বডির পোস্টমর্টেম শেষ। আমাদের হাতে লাশ বুঝিয়ে দিয়েছে। বন্ধুর শরীর দেখে শিউরে উঠলাম। আসলে শরীর না, ওর পায়ের বৃদ্ধাঙ্গুলে ঝুলছে একটি কাগজের ট্যাগ। সেই ট্যাগ, যা সেদিন ওই ভুতুড়ে করিডরের রহস্যময় ঘরটিতে সুজনই আমাকে দিয়েছিল। সেদিন সেই ট্যাগে কি কারও নাম লেখা ছিল, সেটা ঠিকমতো খেয়াল করে পড়িনি, তবে এইটাই যে সেই ট্যাগ, আমি হান্ড্রেড পার্সেন্ট নিশ্চিত!’
আকরাম ভাই কথা থামিয়ে পানির গ্লাসে চুমুক দিলেন। তিনি একটানে বলে গেছেন, আমিও একনিশ্বাসে শুনে গেছি।
‘কাকতালীয় কোনো স্বপ্ন নয়তো?’
আমি প্রশ্ন করলাম। তিনি বললেন, ‘সেটা ছাড়া আর কোনো ব্যাখ্যা কি আছে?’
তারপর তিনি ছোট একটি শ্বাস ফেলে গলার স্বর পাল্টে বললেন, ‘দেখো মঞ্জুর, আমি কিন্তু যথেষ্ট যুক্তিবাদী মানুষ। এই সব জাদুটোনা–ভৌতিক গালগপ্পে আমার বিশ্বাস নেই। ব্যাপারটা আমার নিজের সঙ্গে না ঘটলে আমাকে মেরেকেটেও কেউ বিশ্বাস করাতে পারত না। তারপরও আমি ধরে নিলাম, এটি অবশ্যই একটি স্বপ্ন ছিল। সুজনের মৃত্যুটা একটা কাকতালীয় দুর্ঘটনা। বাস্তবে এটি কোনোভাবেই সম্ভব নয়। কিন্তু তারপর আরও বেশ কয়েকবার ঘটনা ঘটল।’
‘বলেন কী!’ কথাটি আমি যদিও তখনো শতভাগ বিশ্বাস করিনি, তারপরও মুখফুটে সত্যিকারের বিস্মিত স্বর বেরিয়ে এল।
‘হুম্। আমার বহু আত্মীয়ের, কলিগের মৃত্যুর খবর আমি এক–দুই সপ্তাহ আগে টের পেয়েছি।’
‘প্রতিবার তাঁদের সেই সাদা করিডরের কামরায় দেখেছেন?’
‘না। এইটাই অদ্ভুত। একেকবার একেকভাবে ঘটেছে ঘটনা। প্রতিবারই আমি কোনো না কোনো উপায়ে অন্য ভুবনে চলে যাই। যেমন ধরো, প্রথমবার আমি চলন্ত অবস্থায় ছিলাম, মাঝেমধ্যে বিছানায় শোয়া অবস্থাতেও সে জগতে পৌঁছেছি। প্রতিবারই নতুন নতুন জায়গা দেখি। ধরো, একবার দেখলাম উঁচু পাহাড়ের ওপর আমি দাঁড়িয়ে আছি। আমার সঙ্গে আমার কলিগ জনাথন। আমার বয়সী ছেলে। প্রতিদিন জিম করে, স্বাস্থ্যকর খাবার খায়। রেগুলার ডাক্তারি পরীক্ষা করায়। নিজের শরীর স্বাস্থ্য নিয়ে যথেষ্ট সচেতন। দেখলাম, আমরা দুজনে সেখানে কিছু একটা খুঁজছি। হঠাৎ সে বসে পড়ল। আমি বললাম কী হয়েছে? সে কিছু বলল না, উল্টো শুয়ে পড়ল। ব্যস, এই পর্যন্তই। আমি বাস্তবের ওকে বললাম কিছুদিন সাবধানে চলাফেরা করতে। দেখেশুনে গাড়ি চালাতে। লাভ হলো না। সে মারা গেল ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাকে। এত সুস্থ–সবল ছেলে হার্ট অ্যাটাকে কীভাবে মরে কে জানে!’
আমি কিছু বললাম না। কী বলব, সেটাই মাথায় আসছে না। অবিশ্বাস্য কথাবার্তা। কিন্তু আকরাম ভাইয়ের মতো মানুষ শুধু শুধু মিথ্যা কথা বলবেনই–বা কেন?
‘আমার মায়ের মৃত্যুর কথাটাই ধরো। আমি আগেভাগে টের পেলাম। মা তখন দিব্যি সুস্থ–সবল মহিলা। সাবধান হলাম। মাকে সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতালে নিয়ে গেলাম। ফুল বডি চেকআপ করাব। সেখানেই তাঁর স্টমাক ক্যানসার ধরা পড়ল। আর্লি স্টেজ। সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসা শুরু করে দিলাম। কিন্তু তিনি মারা গেলেন এক মাস পরেই, স্ট্রোক করেছিল।’
আমি দীর্ঘশ্বাস ছাড়লাম। আকরাম ভাই নিজের মাকে জড়িয়ে মিথ্যা বলবেন না নিশ্চিত। অদ্ভুত শোনালেও তিনি সত্যিই বলছেন।
‘আপনি যাকেই স্বপ্নে দেখেন, তাঁরই মৃত্যু ঘটে?’
‘হুম্। একদম যাকে দেখি, সেই মারা যায়।’
‘আপনার এই ক্ষমতার কথা ভাবি বা অন্য কেউ জানেন?’
আকরাম ভাই বললেন, ‘না, কাউকে বললে সে বিশ্বাস করবে না। আমাকে পাগল ভাববে। মনে করবে অ্যাটেনশন পেতে চাইছি। রিয়েলটরি করি, লোকে ভাববে এইটা কোনো বিশেষ ধরনের অ্যাডভার্টাইজমেন্ট। ধান্দাবাজি করছি।’
‘তাও ঠিক।’
এ ছাড়া আমার আর কী বলার আছে বুঝতে পারছি না।
‘তোমাকে বললাম বিশেষ কারণে। এই আজকেই আমার সঙ্গে আবারও ঘটনাটা ঘটেছে। তবে এবার সম্পূর্ণ নতুন জিনিস দেখলাম। দেখলাম, আমি একটি শহরে প্রবেশ করতে যাচ্ছি। অদ্ভুত একটি শহর। অনেক উঁচু উঁচু বাড়িঘর, আমাদের ডাউনটাউনগুলোয় সাধারণ স্কাইস্ক্র্যাপারগুলো বা বুর্জ খলিফার মতো উঁচু না, তার চেয়েও বহুগুণ উঁচু একেকটি ভবন। আকাশ ঢেকে গেছে বাড়িগুলোর উচ্চতায়, এমন উঁচু। পুরো শহর মানুষে গিজগিজ করছে। রাস্তায় মানুষ, ফুটপাতে মানুষ, বাড়িঘরের জানালায় মানুষ আর মানুষ। কোনো গাড়িঘোড়া–বাস নেই। শুধুই মানুষ। কেউ কারও দিকে তাকাচ্ছে না, সবাই কেবল হেঁটেই যাচ্ছে। ব্যস্ত সড়কের ব্যস্ত মানুষের খুবই স্বাভাবিক আচরণ। কিন্তু হঠাৎই সবাই থমকে গেল। তার চেয়ে ভীতিকর হলো সবাই তখন স্থির দাঁড়িয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। ভাবলেশহীন একেকটি চেহারা। কোনো আনন্দ, উচ্ছ্বাস বা বিষাদ বোঝার উপায় নেই। নিষ্প্রাণ দৃষ্টি সবার। সুতা পরিমাণ নড়চড় নেই কারও।
‘আমি আঁতকে উঠলাম। ওদের থেকে সরে যেতে চাইলাম। কেউ বাঁধা দিল না। ভিড় ঠেলে আমি ছুটতে চাইছি। ধাক্কা দিয়ে সামনে থেকে লোকজন সরাচ্ছি। সবাই সরছে, কিন্তু কারোরই দৃষ্টি আমার ওপর থেকে নড়ছে না। তারপর আবার আমি আগের জায়গায়, মানে নিজের গাড়িতে ফিরে এলাম। দেখি ট্রাফিক সিগন্যালে দাঁড়িয়ে আছি। সামনে লাল বাতি জ্বলে আছে।’
‘খুবই অদ্ভুত। আপনি ওই জগতে থাকলেও এই জগতের কাজ কিন্তু ঠিকই চালিয়ে যান।’
‘সেটাই। এমন না যে গাড়ি চলন্ত অবস্থায় আমি সে জগতে এবং এ জগতে আমি অ্যাকসিডেন্ট করে ফেললাম। এমনটা কখনোই হয়নি।’
‘ওই জগতের কোনো চিহ্ন আপনি আনতে পারেন না, তাই না?’
‘না। সুজনের দেওয়া ট্যাগ সেখানেই হারিয়ে আসি, যদিও চিমটির দাগ ছিল আমার হাতে। অন্যদের ক্ষেত্রেও তা–ই ঘটে। আরেকবার এমনই এক ঘটনায় ইচ্ছা করেই মাটিতে পড়ে নিজের হাঁটুর চামড়া ছিলেছিলাম, বাস্তবে এসে দেখি আমার হাঁটুর চামড়া ছিলা। মোটকথা, ব্যাপারটা খুবই রহস্যময়, একটা ঘটে তো আরেকটা ঘটে না। কোনো সূত্রেই ফেলা যায় না। কেন ঘটছে, কিছুই বুঝি না। লোকজনকে বলতেও পারি না।’
আমি তাঁর দিকে নিজের হাত বাড়িয়ে বললাম, ‘ভাই, আমি আপনাকে বিশ্বাস করছি। যদিও এটাও বলব যে আপনি যা বলছেন, খুবই অবিশ্বাস্য কথাবার্তা। আপনি না হয়ে অন্য কেউ হলে অবশ্যই বিশ্বাস করতাম না।’
‘এই প্রথম আমি এত বিপুলসংখ্যক মানুষ একসঙ্গে দেখেছি। ব্যাপারটা আমার কাছে ভালো লাগছে না। কেন যেন মনে হচ্ছে, খুব দ্রুত একটা বিশ্বযুদ্ধ টাইপ কিছু লাগবে। প্রচুর মানুষ মারা যাবে।’
আমি বুঝলাম না কী বলা উচিত।
‘কোনো বিশেষ জাতির মানুষ দেখেছেন?’
‘না, এখানে যেমন সব জাতির মানুষ দেখা যায়, স্বপ্নেও তাই দেখলাম। আরেকটা ডিটেইলের কথা তোমাকে বলি। আমরা যেমন এখানে পোশাক পরি, সেখানে কাউকে কোনো ড্রেসে আমি দেখি না। মানে তাঁরা নগ্নও থাকে না, কিন্তু কোনো পোশাকও না। অদ্ভুত ব্যাপার, বলে বোঝাতে পারছি না। ছবি আঁকার ক্ষমতা থাকলে এঁকে দেখাতাম।’
‘আজ পর্যন্ত কখনো স্বপ্ন ব্যর্থ হয়নি?’
তিনি আত্মবিশ্বাসী স্বরে বললেন, ‘না।’
তারপর একটু বিরতি নিয়ে বললেন, ‘আমি জানি, আমার ব্যক্তিগত ও পেশাগত রেপুটেশন এর ওপর নির্ভরশীল। তুমি যদি দেখো আগামী কয়েক মাসে কিছুই ঘটেনি, তখন তুমিই ভাববে আমি চাপা মেরেছিলাম। হয়তো ক্যানভাসে, ফেসবুকে কিছু একটা লিখে হাসিতামাশাও করবে। কিন্তু আমি নিশ্চিত, কিছু একটা খুব শিগগির ঘটবে। সবার সাবধান হওয়া উচিত।’
তখন ডিসেম্বর মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ চলছে। ২০১৯ সাল। ডোনাল্ড ট্রাম্প আমেরিকার প্রেসিডেন্ট। এক অদ্ভুত খ্যাপাটে বর্ণবাদী লোকের হাতে বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী দেশ ও মিলিটারির ক্ষমতা। আমরা প্রতিদিন আতঙ্কে থাকি, এই বুঝি কোনো দেশের ওপর নিউক্লিয়ার বোমা ছেড়ে দিল। এই বুঝি যুদ্ধ বেধে গেল। উত্তর কোরিয়ার যুদ্ধ বাধি বাধি করেও বাধল না শেষ পর্যন্ত। চরম মুসলিমবিদ্বেষী হয়েও মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধে জড়াল না। আমরা হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম। কিন্তু নিজের মেয়াদের শেষ বছরে সে কী করে বসে তারতো ঠিক নেই।
সে ঘটনার দুই সপ্তাহ পরেই সে আশঙ্কা সত্যি করে দেখাল। জানুয়ারি মাসের তিন তারিখে সে ইরানের প্রধান সমরবিদ জেনারেল কাসেম সুলাইমানিকে রকেট হামলায় বাগদাদে হত্যা করল।
ইরানই–বা চুপ থাকবে কেন? ওরাও ইরাকের ইউএস সেনাঘাঁটিতে পাল্টা ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করল। এর মধ্যে ওদের ছোড়া রকেটে ওদেরই দেশের একটি যাত্রীবাহী বিমান বিধ্বংস হয়ে বহু সিভিলিয়ান যাত্রী নিহত হলেন। সিংহভাগই ছিলেন বিদেশি। তখন যুদ্ধ বাধা কেবল সময়ের ব্যাপার। আমার মনে পড়ে গেল আকরাম ভাইয়ের কথা। চরম ভয় পেয়েছিলাম। কারণ আমরা সবাই জানি আধুনিক বিশ্বে একবার যুদ্ধ শুরু হলে সেটি শেষ করা অতি অতি কঠিন। যুগের পর যুগ কেটে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে, তারপরও যুদ্ধের নিষ্পত্তি হয় না। মাঝে দিয়ে শুধু হতাহত মানুষের সংখ্যা বাড়ে। বাড়ে গৃহহীন শরণার্থীর সংখ্যা। সমুদ্রসৈকতে ঢেউ এনে আছড়ে ফেলে কোনো নিষ্পাপ শিশুর লাশ।
আকরাম ভাই বলেছিলেন, ‘আমি নিশ্চিত, আমাদের সামনে ভীষণ দুর্দিন আসছে। একটা বিশ্বযুদ্ধ বাধবেই, প্রচুর মানুষ মারা যাবে তাতে। এবং সেটা এক–দুই মাসের মধ্যেই ঘটবে।’
এই চরম সংকটময় মুহূর্তে, এই অদ্ভুত কাকতালে আমি আল্লাহ আল্লাহ করলাম। অবচেতন মন কেন যেন নিশ্চিত হয়ে গেল সামনে দুর্দিন আসছেই। ভীষণ দুর্দিন!
ইরান ও আমেরিকা তখন অদ্ভুত সংযম দেখাল। দুই দলই যুদ্ধাবস্থান থেকে সরে এল। অহংকার, দম্ভ, আত্মসম্মান ইত্যাদি কিছুই বাধা হয়ে দাঁড়াল না। নিশ্চিতভাবেই কয়েক লাখ সিভিলিয়ান বেঁচে গেলেন। এটি যেকোনো অলৌকিকতা থেকে কম নয়।
কিন্তু মৃত্যুদূত পরোয়ানা হাতে এলেন ভিন্নদিক থেকে। তখনই চীন জানাল এক নতুন ধরনের করোনাভাইরাস ছড়াতে শুরু করেছে। এর থেকে সৃষ্ট রোগের নাম কোভিড-১৯। কেউ বুঝতে পারছে না কেন, কীভাবে হচ্ছে। তার চেয়ে ভয়াবহ ব্যাপার, কেউ জানে না কীভাবে এর চিকিৎসা হওয়া উচিত!
কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই এশিয়া থেকে ইউরোপ হয়ে আমেরিকায় ছড়িয়ে গেল ভাইরাসটি। ইউরোপে হাজারে হাজারে মানুষ মারা গেলেন তো আমেরিকায় মারা গেলেন লাখে লাখ। বিশ্বের সবচেয়ে আধুনিক এবং শক্তিশালী দেশের সাড়ে ছয় লাখের বেশি মানুষ একটি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র জীবাণুর হাতে মারা পড়লেন।
নিউইয়র্কের মর্গে লাশের স্থান হয় না, বিশাল বিশাল এইটিন হুইলার এনে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত করে লাশ রাখতে হয়। সেই স্থানও দ্রুত ফুরিয়ে যাওয়ায় মৃতের বাড়িতেই রুমের দরজা আটকে লাশ রাখতে শুরু করে। নিজের হাতে নিজের চোখ–নাক ঠোঁট ছুঁতে ভরসা পাই না, আতঙ্কে থাকি, এই না আক্রান্ত হই! ঠান্ডার কারণেও গলা খুসখুস করলে ভয়ে কলিজা শুকিয়ে আসে। স্কুল, কলেজ, অফিস সব বন্ধ ঘোষণা করা হলো। নিজের বাড়িতেই নিজেদের বন্দিজীবন তখন শুরু। সে এক অবিশ্বাস্য অতিলৌকিক সময় চলছে আমাদের সবার জীবনে।
নিহত ব্যক্তিদের তালিকায় আমাদের আকরাম ভাইও ছিলেন। অতিমারি শুরু হওয়ার ঠিক আগে পরিবারসহ নিউইয়র্কে বেড়াতে গিয়ে আটকা পড়েছিলেন। সেখানেই সংক্রমিত হন, সেখানেই তিনি মারা যান। আমার সঙ্গে তাঁর শেষ দেখা ও কথা ডালাসের সেই বাঙালি রেস্টুরেন্টের ক্যাফেটেরিয়ায়। তিনি নিশ্চিত করেই বলেছিলেন, আমরা বিরাট বিপদে পড়তে যাচ্ছি। লাখো মানুষের মৃত্যু কিছুতেই ঠেকানো যাবে না।
আকরাম ভাই বলেছিলেন, ‘আমার কথা মিথ্যা প্রমাণিত হলে তুমি ফেসবুকে ক্যানভাসে গল্প লিখে হাসাহাসি করবে।’
‘প্রথম দিনই ফুড পয়জনিং হয়ে গেল। এতটাই খারাপ অবস্থা যে এক রাত হাসপাতালে কাটাতে হয়েছিল। মনে মনে হাসছিলাম। আমার দেশি পেট বুঝি নিজেকে ইংরেজ ভাবতে শুরু করেছিল, তাই বাঙালি খাবার পেটে যেতেই বিদ্রোহ করেছে। হা হা হা।’
আমিও হাসলাম। প্রতিটা প্রবাসীর দেশে গেলে এই যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। অতি সাবধানে খাওয়াদাওয়া করতে হয়। একটু পান থেকে চুন খসলেই খাঁটি ভেজালমুক্ত খাবারে অভ্যস্ত হয়ে যাওয়া পাকস্থলী তখন দ্রোহী হয়ে ওঠে।
‘সুস্থ হওয়ার পরে ছুটলাম পুরান ঢাকার দিকে। বিরিয়ানি খেতে হবে। মাত্র এক মাসের জন্য গেছি বেড়াতে। সময় একদমই নেই। পেট খারাপ হলে হবে, ওষুধ খেয়ে ঠিক করা যাবে। ডালাসে আমাকে নান্না আর হাজির বিরিয়ানি কে এনে দেবে?’
কথা ঠিক। আমি নিজেও দেশে গেলে পুরান ঢাকায় ছুটি। দেশি খাবারের কারোর স্মৃতিচারণাও আমার জিবে জল নিয়ে আসে, যেমনটা এখন আনল। তিনি বর্ণনাও শুরু করেননি, অথচ আমি ঠিক চোখের সামনে দেখলাম বিরাট লাইন অতিক্রম করে আমি হাজি সাহেবের রেস্তোরাঁ বসার সুযোগ পেয়েছি। আমার সামনে এক প্লেট গরম-গরম বিরিয়ানি রাখা হয়েছে। তা থেকে ভেসে আসছে শর্ষের তেলে ভাজা খাসির মাংসের ঘ্রাণ! সঙ্গে সালাদ হিসেবে কিছু শসা, মরিচ আর টমেটো। এক গ্লাস বোরহানি এনে এই মাত্র রাখল পাশে। টেবিলে গ্লাস রাখার শব্দটাও যেন স্পষ্ট শুনতে পেলাম। আহ্!
‘গুলিস্তান মোড়ে পৌঁছে রিকশা নিলাম, আমি আর আমার বন্ধু ইলিয়াস। জসিম আর সুজনও আছে আমাদের সঙ্গী, তবে ওরা অন্য রিকশায় চেপেছে। আমরা চারজন একদম নার্সারি ওয়ান থেকে বন্ধু। স্কুল, কলেজ, ইউনিভার্সিটি সব একসঙ্গে। তাই খুব হইহুল্লোড় করতে করতে যাচ্ছি। বয়স ছিল তরুণ, মন ছিল নির্ভার এবং ফুর্তিতে ভরপুর। বুঝতেই পারছ।’
আমি বুঝতে পারছি। একই বয়স আমিও কাটিয়ে এসেছি।
‘তা হঠাৎই আমার মনে হলো রিকশার গতি বাড়তে শুরু করেছে। অস্বাভাবিক হারে বাড়ছে। আশপাশের সবকিছু হঠাৎ শ্লথ হয়ে গেছে, আমাদের রিকশাই কেবল বাতাসের বাধা কেটে উল্কার বেগে সামনের দিকে ছুটছে। হাওয়ার চাপে আমি তখন টিকে থাকতে পারছি না। মনে হচ্ছে, এই বুঝবি রিকশা থেকে ছিটকে পড়ব। অথবা উড়েই যাব! শিউরে উঠলাম। ইলিয়াসের হাত ধরতে যাব, কিন্তু পাশে দেখি সে নেই। সামনে রিকশাওয়ালাও গায়েব হয়ে গেল। রিকশা আপনাতেই দুরন্ত বেগে ছুটছে। আমি চিৎকার দিতে চাইলাম, মুখ থেকে শব্দও বেরোল, কিন্তু বাতাস সে শব্দ ঠেলে পেছনে নিয়ে গেল। যেন রিকশা না, আমি কোনো রকেটের ছাদে বসে আছি। আমি নিজেকে সামলাতে পারছি না। রিকশার হুড চেপে ধরে আছি। চোখ খুলে রাখতে কষ্ট হচ্ছে। বন্ধ করতে সাহস পাচ্ছি না। কোথায় না কোথায় গিয়ে আছড়ে পড়ি! রিকশা থেকে লাফ দেব, সে উপায়ও নেই।
চা আর প্যাটিস হাতে আমরা আড্ডায় বসে গেলাম। এটা-সেটা নানা বিষয়ে কথা হলো। এর–ওর খোঁজ নেওয়া হলো। তারপর কথা থেকে কথার সূত্র ধরে ধরেই তিনি বললেন, ‘তুমি অলৌকিকতায় বিশ্বাস করো?’
‘সেবার আমি আমেরিকা আসার পরে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশে বেড়াতে গেছি। এক বছরের মাথাতেই। দেশকে পাগলের মতো মিস করি। বন্ধুদের আড্ডা, শহরের কোলাহল, দোকানের খাবার সবকিছুর জন্য মন হাহাকার করে ওঠে। এয়ারপোর্ট থেকে বাড়িতে গিয়ে লাগেজ নামিয়েই বেরিয়ে গিয়েছিলাম বন্ধুবান্ধব নিয়ে আনোয়ারের দোকানে চা খেতে খেতে আড্ডা দিতে। সঙ্গে গরম-গরম তেলে ভাজা ধোঁয়া ওঠা শিঙারা। আনোয়ার করত কী, শিঙাড়ার সঙ্গে টমেটো সসের বদলে কাসুন্দির মতো ঝাঁজালো শর্ষের একটা সস দিত। ইশ্! যদি একবার কাঁচা পেঁয়াজ আর সেই সস দিয়ে শিঙারা খেতে, তাহলে বুঝতে কী অমৃত যে লাগত! এ দেশে বাংলাদেশি স্টাইলে শিঙারা কেউ বানায় না। সবাই ইন্ডিয়ান গ্রাহক পেতে ইন্ডিয়ান শিঙারা বানায়। ওটা মুখে দেওয়া যায়?’
আমি মাথা নেড়ে সায় দিলাম। বাস্তবেই, যে বাঙালি শিঙাড়ায় অভ্যস্ত, তাঁর কাছে পাঞ্জাবি শিঙারা ভালো লাগার কথা না।
‘প্রথম দিনই ফুড পয়জনিং হয়ে গেল। এতটাই খারাপ অবস্থা যে এক রাত হাসপাতালে কাটাতে হয়েছিল। মনে মনে হাসছিলাম। আমার দেশি পেট বুঝি নিজেকে ইংরেজ ভাবতে শুরু করেছিল, তাই বাঙালি খাবার পেটে যেতেই বিদ্রোহ করেছে। হা হা হা।’
আমিও হাসলাম। প্রতিটা প্রবাসীর দেশে গেলে এই যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। অতি সাবধানে খাওয়াদাওয়া করতে হয়। একটু পান থেকে চুন খসলেই খাঁটি ভেজালমুক্ত খাবারে অভ্যস্ত হয়ে যাওয়া পাকস্থলী তখন দ্রোহী হয়ে ওঠে।
‘সুস্থ হওয়ার পরে ছুটলাম পুরান ঢাকার দিকে। বিরিয়ানি খেতে হবে। মাত্র এক মাসের জন্য গেছি বেড়াতে। সময় একদমই নেই। পেট খারাপ হলে হবে, ওষুধ খেয়ে ঠিক করা যাবে। ডালাসে আমাকে নান্না আর হাজির বিরিয়ানি কে এনে দেবে?’
কথা ঠিক। আমি নিজেও দেশে গেলে পুরান ঢাকায় ছুটি। দেশি খাবারের কারোর স্মৃতিচারণাও আমার জিবে জল নিয়ে আসে, যেমনটা এখন আনল। তিনি বর্ণনাও শুরু করেননি, অথচ আমি ঠিক চোখের সামনে দেখলাম বিরাট লাইন অতিক্রম করে আমি হাজি সাহেবের রেস্তোরাঁ বসার সুযোগ পেয়েছি। আমার সামনে এক প্লেট গরম-গরম বিরিয়ানি রাখা হয়েছে। তা থেকে ভেসে আসছে শর্ষের তেলে ভাজা খাসির মাংসের ঘ্রাণ! সঙ্গে সালাদ হিসেবে কিছু শসা, মরিচ আর টমেটো। এক গ্লাস বোরহানি এনে এই মাত্র রাখল পাশে। টেবিলে গ্লাস রাখার শব্দটাও যেন স্পষ্ট শুনতে পেলাম। আহ্!
‘গুলিস্তান মোড়ে পৌঁছে রিকশা নিলাম, আমি আর আমার বন্ধু ইলিয়াস। জসিম আর সুজনও আছে আমাদের সঙ্গী, তবে ওরা অন্য রিকশায় চেপেছে। আমরা চারজন একদম নার্সারি ওয়ান থেকে বন্ধু। স্কুল, কলেজ, ইউনিভার্সিটি সব একসঙ্গে। তাই খুব হইহুল্লোড় করতে করতে যাচ্ছি। বয়স ছিল তরুণ, মন ছিল নির্ভার এবং ফুর্তিতে ভরপুর। বুঝতেই পারছ।’
আমি বুঝতে পারছি। একই বয়স আমিও কাটিয়ে এসেছি।
‘তা হঠাৎই আমার মনে হলো রিকশার গতি বাড়তে শুরু করেছে। অস্বাভাবিক হারে বাড়ছে। আশপাশের সবকিছু হঠাৎ শ্লথ হয়ে গেছে, আমাদের রিকশাই কেবল বাতাসের বাধা কেটে উল্কার বেগে সামনের দিকে ছুটছে। হাওয়ার চাপে আমি তখন টিকে থাকতে পারছি না। মনে হচ্ছে, এই বুঝবি রিকশা থেকে ছিটকে পড়ব। অথবা উড়েই যাব! শিউরে উঠলাম। ইলিয়াসের হাত ধরতে যাব, কিন্তু পাশে দেখি সে নেই। সামনে রিকশাওয়ালাও গায়েব হয়ে গেল। রিকশা আপনাতেই দুরন্ত বেগে ছুটছে। আমি চিৎকার দিতে চাইলাম, মুখ থেকে শব্দও বেরোল, কিন্তু বাতাস সে শব্দ ঠেলে পেছনে নিয়ে গেল। যেন রিকশা না, আমি কোনো রকেটের ছাদে বসে আছি। আমি নিজেকে সামলাতে পারছি না। রিকশার হুড চেপে ধরে আছি। চোখ খুলে রাখতে কষ্ট হচ্ছে। বন্ধ করতে সাহস পাচ্ছি না। কোথায় না কোথায় গিয়ে আছড়ে পড়ি! রিকশা থেকে লাফ দেব, সে উপায়ও নেই। আমার শরীর পুরোপুরি অবশ তখন। সিটের সঙ্গে যেন গেঁথে গেছি।
‘যেভাবে হঠাৎই রিকশা চলতে শুরু করেছিল, ঠিক সেভাবেই হঠাৎই থেমে গেল। আমার হার্টবিট তখন ২০০ থেকে ৩০০ হবে নিশ্চিত। হৃৎপিণ্ড যে ফেটে যায়নি, সেটাই বিস্ময়কর। খানিকটা স্থির হয়ে আমি যখন আশপাশে চোখ বুলাই, দেখি আমি এক সম্পূর্ণ অন্য জগতে চলে এসেছি। আমি একটি করিডরের মাঝে দাঁড়িয়ে আছি। আমার দুপাশে ধবধবে সাদা দেয়াল যেন আকাশ ফুঁড়ে দাঁড়িয়ে আছে। ওপর চোখ তুলে ছাদ বোঝার চেষ্টা করলাম, সম্ভব হলো না। অসীমে, যেখানে চোখের দৃষ্টিও হার মানে, আমি দেখলাম দেয়াল তখনো কেবল উঠছেই। আর সামনে–পেছনেও কোথা থেকে শুরু হয়ে কোথায় গিয়ে শেষ হয়েছে, কিছুই বুঝতে পারছি না। সবচেয়ে অদ্ভুত হচ্ছে আমি আলো দেখতে পাচ্ছি, কিন্তু আলোর উৎস খুঁজে পাচ্ছি না। দেয়ালে কোনো লাইট–বাল্ব নেই, কিন্তু পুরো করিডর ভেসে যাচ্ছে স্থির আলোর বন্যায়। সবচেয়ে অদ্ভুত হচ্ছে, আমার ছায়া আমি দেখতে পারছি না। ধবধবে সাদা মেঝের কোথাও আমার বা রিকশার ছায়া নেই।
‘রিকশা থেকে নেমে আমি হাঁটতে শুরু করলাম। দুপাশের দেয়ালে কোনো দরজা নেই, জানালা নেই। বুঝতে পারছি না কোথায় এসেছি, কীভাবে এসেছি। গায়ে চিমটি কেটে দেখলাম আমি স্বপ্ন দেখছি না তো। ব্যথা টের পেলাম, ঘুম ভাঙল না। বুঝলাম, আমি বাস্তবেই আছি।
‘হাঁটতে হাঁটতে একবার পেছন ফিরে তাকালাম। রিকশাটা গায়েব! যেন হাওয়ায় মিলিয়েছে বা মেঝে গিলে খেয়েছে। কোনো চিহ্ন নেই। আমি ভয়ে আঁতকে উঠলাম। ছুটলাম সামনের দিকে। দৌড়াচ্ছি এবং হাঁপাচ্ছি। আবারও বুঝলাম এটি স্বপ্ন না। অবাস্তব অভিজ্ঞতা হলেও এটাই বাস্তব। দীর্ঘক্ষণ দৌড়ানোর পর যখন আমার নিশ্বাস ধরে এল, কিছুতেই চলার শক্তি নেই, তখন পেছন ফিরে বোঝার চেষ্টা করলাম কত দূর এগিয়েছি। বোঝার কোনোই উপায় নেই। সব এক। কংক্রিটের দেয়াল, কংক্রিটের মেঝে। দুধসাদা, ধবধবে। কোনো ময়লা, দাগ বা চিহ্ন নেই কোথাও, যা দেখে দূরত্ব মাপব। মনে হচ্ছে যেন একচুলও এগোইনি।
‘ঠিক এই সময়ে দেখলাম ২০ থেকে ২৫ হাত দূরে দেয়াল থেকে হঠাৎই একটি দরজা স্লাইড করে খুলে গেল। আমি হাঁপাতে হাঁপাতে সেদিকেই এগোলাম। দরজার ভেতরে ঢুকব কি না ভাবছি। না ঢুকে উপায়ও তো নেই।
‘আমি ভেতরে ঢুকে গেলাম। এটিও ধবধবে সাদা কামরা। তবে স্বস্তির কথা, আমার সামনে আমার বন্ধু সুজনকে দেখলাম বসে আছে।
‘আমি হাহাকার করে বললাম, “সুজন, এটা কোন জায়গা! কোথায় আমরা? কীভাবে এলাম?”’
‘সুজন আমাকে দেখে স্মিত হাসল, কিছু বলল না, তবে তাঁর শান্ত–সৌম্য দৃষ্টি দেখে বুঝলাম, সে আমাকে বলছে চিন্তার বা ভয়ের কিছু নেই।
‘আমি আরও কিছু বলতে গেলাম, কিন্তু সে আমার হাতে একটি কাগজ ধরিয়ে দিল। আমি হাতে নিয়ে দেখি ওটা একটা কাগজের ট্যাগ। নাম, বয়স, লিঙ্গ ইত্যাদি লেখা।’
‘এটা কী?’
‘সে কোনো জবাব দিল না। আবারও স্মিত হাসি হাসল। আমার কাঁধে হাত রাখল।
‘পেছনে ক্যাঁচ ক্যাঁচ করে একটা আওয়াজ হলো। আমি ফিরে দেখি দরজা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। আমি বললাম, “দরজা বন্ধ হলে এ ঘরে আটক পড়ব যে! জলদি বের হ!”
‘বলেই বুঝে না বুঝে আমি দৌড় দিলাম। বেরিয়ে করিডরে পৌঁছাতে পৌঁছাতে দেখি আমি হাজির বিরিয়ানির সামনে দাঁড়িয়ে আছি। আমার পাশে আমার চার বন্ধু, আমাদের ঘিরে পুরান ঢাকার স্বাভাবিক জনরোল। কিছু একটা ব্যাপারে হা হা হো হো করে বন্ধুরা হাসছে। বুঝলাম না আমি কি এতক্ষণ স্বপ্ন দেখছিলাম? হাতে তখন ট্যাগটা নেই, তবে সেই যে কবজিতে চিমটি কেটেছিলাম, সেই নখের দাগ ঠিকই হাতে রয়ে গেছে।
‘বন্ধুদের কিছু জানালাম না। বাস্তবের কিছু স্বপ্নের কথা এত দিন শুনে এসেছি, ভেবে নিলাম এটিও তেমন কিছুই হবে। আড্ডায়, খাওয়াদাওয়ায় যোগ দিলাম। এক সপ্তাহ সে রকমই কাটল। আমি চলে গেলাম রাজশাহী, দেশের বাড়ির কিছু আত্মীয়ের সঙ্গে দেখা করতে। পরের সোমবার দুপুরে খবর পেলাম সুজন অ্যাকসিডেন্টে মারা গেছে। মোটরসাইকেল নিয়ে বেরিয়েছিল, বাসের ধাক্কায় সে স্পট ডেড
Source: Prothomalo