মহাসড়ক মানেই মহাদুর্ভোগ
নিউজ ডেস্ক : ঢাকা থেকে সিলেট, রংপুর, খুলনা ও বরিশালে যাওয়ার দেশের চারটি গুরুত্বপূর্ণ মহাসড়ক রয়েছে। এগুলোর সম্মিলিত দূরত্ব ১ হাজার ৬০ কিলোমিটার। এসব মহাসড়ক ঘুরে প্রথম আলোর ১৬ প্রতিনিধির পাঠানো তথ্য বলছে, এই চার মহাসড়কের ৩৫০ কিলোমিটারই দুর্ভোগ সঙ্গী করে চলতে হয়। এর মধ্যে প্রায় ৬৭ কিলোমিটার খুবই বেহাল, যানবাহন চলছে খুব কষ্ট করে। বাকিটিতে আছে ভাঙাচোরা-খানাখন্দ। ঢাকা-চট্টগ্রাম পথের দূরত্ব ২৪২ কিলোমিটার এবং গত বছর চার লেনে উন্নীত করার পর সড়কটি এখন ভালো। তবে মেঘনা-গোমতী সেতুতে অব্যবস্থাপনার কারণে যানজট নিত্যদিনের ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চল বাদ দিলে দেশের প্রায় সব জেলার বাসিন্দাদেরই এই পাঁচ মহাসড়কের পুরোটা অথবা আংশিক ব্যবহার করে চলতে হয়। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের (ডব্লিউইএফ) প্রতিযোগিতা-সক্ষমতা প্রতিবেদন ২০১৭ অনুযায়ী, এশিয়ার মধ্যে অন্যতম নিকৃষ্ট সড়কের দেশ হচ্ছে বাংলাদেশ। কেবল নেপাল বাংলাদেশের চেয়ে খারাপ।
সওজের হাইওয়ে ডিজাইন ম্যানুয়াল (এইচডিএম) বিভাগের ২০১৬ সালের আগস্টের প্রতিবেদন অনুসারে, দেশের ৩৭ দশমিক ৩৪ শতাংশ সড়ক-মহাসড়ক খারাপ। ৩৯ শতাংশ সড়ক-মহাসড়ক ভালো। আর সাড়ে ২৩ শতাংশ চলনসই। এরপর তারা গত নভেম্বর থেকে নতুন করে জরিপ শুরু করেছে। এর প্রাথমিক ফল অনুযায়ী, সড়ক-মহাসড়কের অর্ধেকই খারাপের পর্যায়ে চলে গেছে। এর মধ্যে খুলনা অঞ্চলের অবস্থা সবচেয়ে খারাপ। ময়মনসিংহ, রাজশাহী ও রংপুর অঞ্চলের সড়কের অবস্থাও খারাপ। সওজের অধীনে দেশের গুরুত্বপূর্ণ প্রায় ২১ হাজার কিলোমিটার সড়ক আছে। এগুলো জাতীয় মহাসড়ক, আঞ্চলিক মহাসড়ক ও জেলা সড়ক-এই তিন ভাগে ভাগ করা আছে। এর মধ্যে জাতীয় মহাসড়ক ৩ হাজার ৮১৩ কিলোমিটার। এর বাইরে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের (এলজিইডি) অধীন সড়ক আছে ৩ লাখ কিলোমিটারের বেশি; যার সবই গ্রামীণ সড়ক। বাংলাদেশে মানুষ মূলত মোট যাতায়াতের ৮৮ শতাংশই করে সড়কপথে। বাকিটা রেল, নৌ ও আকাশপথে হয়ে থাকে।
সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, ২০০৯-১০ অর্থবছর থেকে ২০১৬-১৭ অর্থবছর-এই আট বছরে সড়ক ও সেতুর দৈনন্দিন রক্ষণাবেক্ষণে ৮ হাজার ৭৬০ কোটি টাকা খরচ করা হয়েছে। আর দেশি-বিদেশি অর্থায়নে বিভিন্ন প্রকল্পের অধীনে রাস্তা তৈরিতে খরচ হয়েছে ৩১ হাজার ৯০ কোটি টাকা। বিভিন্ন প্রকল্পে আর দৈনন্দিন মেরামতের জন্য চলতি অর্থবছরে ১৪ হাজার ৮০০ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। গত বর্ষায় সড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে-এই বিবেচনায় আরও প্রায় ১ হাজার ৩০০ কোটি টাকা মেরামত খাতে বাড়তি বরাদ্দ চেয়েছে সওজ। মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা বলছেন, রাজস্ব খাতের বেশির ভাগ অর্থই ব্যয় হয় যথাযথ দরপত্র ছাড়া, রাজনৈতিক ঠিকাদারদের পেছনে। আর উন্নয়ন প্রকল্পেও নয়ছয়ের কারণে যথাযথ ও সময়মতো কাজ হয় না। অব্যবস্থাপনা তো আছেই। সব মিলিয়ে নতুন কিছু সড়ক-সেতুসহ উন্নয়নমূলক কাজ হলেও এর জন্য মানুষকে চরম মূল্য দিতে হয়।
সড়কের দুরবস্থার বিষয়ে জানতে চাইলে সওজের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী (পরিকল্পনা ও রক্ষণাবেক্ষণ) মো. আবুল কাশেম ভূঁইয়া প্রথম আলোকে বলেন, ভারী বর্ষা ও বন্যার কারণে এবার সড়ক কিছুটা খারাপ। মেরামতের জন্য ঠিকাদার নিয়োগ হয়েছে, কাজও চলছে। আগামী মে মাসের মধ্যে সব সড়ক ঠিক হয়ে যাবে।
গুরুত্বপূর্ণ চার মহাসড়ক
প্রথম আলোর অনুসন্ধানে দেখা গেছে, খানাখন্দ, অপরিকল্পিত উন্নয়ন কর্মকাণ্ড ও অব্যবস্থাপনা-এই তিনে দেশের চারটি গুরুত্বপূর্ণ মহাসড়কে মানুষের যাত্রা দুর্বিষহ হয়ে পড়েছে। ঢাকা থেকে রংপুর পর্যন্ত দূরত্ব প্রায় ৩০৭ কিলোমিটার। যমুনা সেতু হয়ে ঢাকা থেকে রংপুরের দিকে যাত্রা করলে ২১৫ কিলোমিটার পথই দুর্ভোগের যাত্রা। প্রায় তিন বছর ধরে গাজীপুরের জয়দেবপুর থেকে টাঙ্গাইলের এলেঙ্গা পর্যন্ত মহাসড়ক চার লেনে উন্নীত করার কাজ চলছে। এ সময় পুরোনো সড়কটি এই ভাঙে, এই মেরামত-এভাবে চলছে। এখনো চার লেনের কাজ সম্পন্ন হয়নি, ফলে ধুলার ওড়াউড়ি তো আছেই। সেতুগুলোর সম্প্রসারণ চলছে বলে যানজট নিত্যদিনের।
এলেঙ্গা থেকে বঙ্গবন্ধু সেতুর পশ্চিম পাড় পর্যন্ত ৩০-৩৫ কিলোমিটার সড়ক মোটামুটি ভালো আছে। কিন্তু সিরাজগঞ্জের নলকা থেকে চান্দাইকোনা পর্যন্ত ২০ কিলোমিটার সড়কের অবস্থা খুবই খারাপ। ঢাকা-রংপুর মহাসড়কের বগুড়া ও গাইবান্ধা জেলায় পড়েছে ৯৭ কিলোমিটার। এর পুরোটাই খানাখন্দে ভরা। বিশেষ করে গাইবান্ধা অংশের অবস্থা খুবই খারাপ। মাঝেমধ্যে চলে জোড়াতালির মেরামত। একই অবস্থা মহাসড়কের রংপুর অংশের ২৩ কিলোমিটার মহাসড়ক।
ঢাকা-খুলনা মহাসড়কের দূরত্ব ২৭১ কিলোমিটার। মানিকগঞ্জের পাটুরিয়া পর্যন্ত চলনসই। কিন্তু দৌলতদিয়া থেকে খুলনা পর্যন্ত মহাসড়কের অবস্থা বেশ খারাপ। এর মধ্যে যশোর-খুলনা অংশের ৩৩ কিলোমিটার খানাখন্দে ভরা। রাজবাড়ী ও মাগুরা অংশে মেরামতের পরই আস্তরণ উঠে গেছে।
ঢাকা থেকে সিলেটের দূরত্ব ২৪৪ কিলোমিটার। এর মধ্যে প্রায় ৯০ কিলোমিটার অংশ ভাঙাচোরা। বিশেষ করে ব্রাহ্মণবাড়িয়া, হবিগঞ্জ ও সিলেট জেলার অংশে বেশি দুরবস্থা। এই সড়কটি চার লেনে উন্নীত করার লক্ষ্যে চায়না কোম্পানির সঙ্গে প্রাথমিক চুক্তি হয়েছিল। কিন্তু চায়না ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিবকে ঘুষ সাধার কারণে চূড়ান্ত চুক্তি হয়নি। প্রকল্পের অধীনে চলে যাবে বলে কোনো রকমে জোড়াতালির মেরামত দিয়ে চালানো হচ্ছে।
এই মহাসড়কের আরেকটি অংশ টঙ্গী থেকে নরসিংদীর পাঁচদোনা পর্যন্ত। প্রায় ৩০ কিলোমিটার দীর্ঘ এই পথে গর্ত এতই বড় যে কয়েকটি কোম্পানি তাদের বিলাসবহুল বাসের চলাচলের পথ পরিবর্তন করতে বাধ্য হয়েছে।
ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক চার লেনে উন্নীত করা হয়েছে গত বছর। ২৪২ কিলোমিটার দীর্ঘ এই মহাসড়কে এখন খানাখন্দ নেই। তবে মেঘনা ও গোমতী সেতু দুটি দুই লেনের এবং দুই পাশের সড়ক চার লেনের বলে যানজট সেখানে নিত্যদিনের। এর মধ্যে অতিরিক্ত মালবাহী যানবাহন নিয়ন্ত্রণে ওজন নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র স্থাপনের পর জট আরও বেড়েছে।
সড়কপথে ঢাকা থেকে বরিশালের দূরত্ব ২৩৮ কিলোমিটার। ঢাকা-মাওয়া-মাদারীপুর হয়ে যে মহাসড়ক রয়েছে, এটিকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়। পদ্মার এপার অর্থাৎ ঢাকা থেকে মাওয়া পর্যন্ত মহাসড়ক ভালো। তবে এই অংশে সম্প্রসারণকাজ চলছে বলে কিছুটা দুর্ভোগে পড়তে হয়। তবে আসল দুর্ভোগ পদ্মার ওপারে। ফরিদপুরের ভাঙ্গা থেকে মাদারীপুরের কালকিনি পর্যন্ত ৪৭ কিলোমিটার সড়কের বেশির ভাগই খানাখন্দে ভরা। ইট-খোয়া দিয়ে কোনো রকমে মেরামত করার পরও তা টিকছে না। এরপর বরিশালের গৌরনদী থেকে উজিরপুর পর্যন্ত ২৩ কিলোমিটার সড়ক দীর্ঘদিন ধরেই বেহাল।
মেরামতে গলদ, সড়ক ভাঙছে দ্রুত
উন্নয়ন প্রকল্পের অধীনে নির্মাণ ও সম্প্রসারণকাজ চলার সময় বিদ্যমান সড়কের রক্ষণাবেক্ষণ হয় না বললেই চলে। সওজের কর্মকর্তা ও ঠিকাদারদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সাধারণত রক্ষণাবেক্ষণের কাজ করা হয় তিনভাবে। এগুলো হচ্ছে দরপত্রবিহীন, সীমিত ঠিকাদারের মধ্যে দরপত্র ও উন্মুক্ত দরপত্র।
দরপত্রবিহীন কাজ অনেক সময় সওজ নিজে মালামাল কিনে ঠিকাদারের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করে। পরিচিত ঠিকাদারদের দায়িত্ব দেওয়া হয়। কয়েক লাখ টাকার কাজ এভাবে করা হয়। সীমিত দরপত্র হয় সাধারণত জরুরি প্রয়োজনে। তা সাধারণত কোটি টাকার ওপরে। এই দুই প্রক্রিয়ায় যে মেরামত হয়, এর বেশির ভাগই অপচয়। ভারী মেরামতের ক্ষেত্রে উন্মুক্ত দরপত্র আহ্বান করা হয়। এই তিন ধরনের দরপত্রে রাজনৈতিক ঠিকাদারদের দৌরাত্ম্য বেশি। অরাজনৈতিক ঠিকাদার কাজ পেলেও রাজনৈতিক ঠিকাদারকে কমিশন দিতে হয়।
সওজের মাঠপর্যায়ের একাধিক কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, ক্ষমতাসীন দলের পরিচয়হীন কিংবা রাজনৈতিক ঠিকাদারের সঙ্গে সমঝোতা ছাড়া অন্য ঠিকাদারেরা সওজের কার্যালয়ে যেতেই পারেন না। এটা শুধু সওজ নয়, এলজিইডি, গণপূর্ত, গণস্বাস্থ্য, শিক্ষা প্রকৌশল, ওয়াসাসহ অন্য দপ্তরগুলোতে আরও বেশি। আবার মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী, সচিব ও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা প্রায়ই পরিদর্শনের নামে বিভিন্ন জেলায় যান। তখন সড়ক মেরামতের টাকা থেকে তাঁদের আপ্যায়নসহ সব খরচ বহন করা হয়। এর বাইরে সড়ক দ্রুত ভেঙে যাওয়ার অন্যতম কারণ হচ্ছে অতিরিক্ত মালবাহী যানবাহন। বিভিন্ন সড়কে ওজন নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র থাকার পরও অতিরিক্ত মালবোঝাই যান বন্ধ হয়নি।
সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিচালক ও বুয়েটের পুর কৌশল বিভাগের অধ্যাপক মোয়াজ্জেম হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, সড়ক নির্মাণে নিয়োজিত ঠিকাদার, উপকরণ ও নজরদারি-তিনটিতেই ঘাটতি আছে। এ জন্যই দ্রুত সড়ক ভেঙে যাচ্ছে। যথাযথ যন্ত্রপাতি ও দক্ষতা নেই-এমন অপেশাদার ঠিকাদারেরা গুরুত্বপূর্ণ সড়ক নির্মাণ বা মেরামতের কাজ পেয়ে যাচ্ছেন। আর তাঁরা প্রভাবশালী হয়ে থাকেন বলে তাঁদের ওপর নজরদারিও কম।
মোয়াজ্জেম হোসেন মনে করেন, বর্তমানে সড়কে ৩০ বছরের পুরোনো উপকরণ-প্রযুক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে, যা ভারী যানবাহনের চাপ নিতে পারছে না। তাই বিটুমিনের সঙ্গে আধুনিক কিছু উপকরণ ব্যবহার করা গেলে পানি এবং ভারী যানের ক্ষতি থেকে কিছুটা রক্ষা করা যাবে। তবে সবকিছুর আগে নজরদারি জরুরি।